দেখিতে দেখিতে আগুনে আত্মাহুতি দেওয়া প্রতিবাদী তিব্বতির সংখ্যা ১০০ ছুঁই-ছুঁই। ইতিমধ্যেই ৯৯ জন তিব্বতি তাঁহাদের স্বদেশের উপর চিনা দখলদারি ও দমননীতির প্রতিবাদে নিজেদের গায়ে আগুন দিয়া আত্মঘাতী হইয়াছেন। এই আত্মঘাতের সহিত ‘মানববোমা’র সমূহ পার্থক্য রহিয়াছে। অন্য কাহাকেও, এমনকী পীড়নকারী চিনাদেরও আঘাত করা ইহার উদ্দেশ্য নয়। কেন তিব্বতিরা ক্রমাগত আত্মঘাতে লিপ্ত? কারণ প্রথমত, ইহা ছাড়া প্রতিবাদের অন্য কোনও জোরালো পদ্ধতি তাঁহাদের জানা নাই এবং দ্বিতীয়ত, আত্মাহুতির মধ্য দিয়াই তাঁহারা নিজেদের দুরবস্থার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিবেন বলিয়া মনে করেন।
বিশ্বের দৃষ্টি কি তিব্বতিদের দুর্দশার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছে? সংবাদ হয়তো প্রচারিত হইতেছে। চিনা কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর ও নিশ্ছিদ্র পাহারার ফাঁক গলিয়াও আগুনে আত্মাহুতির সেই বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক দৃশ্য হয়তো বিশ্ববাসীকে শিহরিত করিতেছে। তাহাতে চিনা কমিউনিস্টদের প্রতি আবিশ্ব বিরূপতাও রচিত হইতেছে। কিন্তু চিনের তাহাতে কিছু আসে যায় না। কেননা কোনও রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন এ জন্য চিনকে সে ভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নাই, চিনের সহিত বাণিজ্যিক সম্পর্ক রদ করে নাই, চিনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কোনও বয়কট, অবরোধ, এমনকী কার্যকর ভর্ৎসনারও সম্মুখীন হইতে হয় নাই। তিব্বত চিনের ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপার, তিব্বতিদের বিষয়ে অন্য কাহারও কিছু বলার বা করার অধিকার নাই, আগুনে জ্বলিতে থাকা তিব্বতিরা সকলেই দলাই লামার অনুচর, চিনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশে লিপ্ত ষড়যন্ত্রকারী, ইত্যাদি প্রচারে তিব্বতিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের গোটা বিষয়টি ধামা-চাপা দেওয়া হইতেছে। চিন এখন নবোদিত বৃহৎ শক্তি, তাহার আর্থিক-সামরিক শক্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ভয় করে, ইউরোপ কোন ছার। দক্ষিণ চিন সাগরের বিবিধ দ্বীপের উপর দখলদারি দাবি করিয়া চিন সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে তটস্থ করিয়া রাখিয়াছে। অতএব তিব্বতিদের প্রসঙ্গ তুলিয়া তাহাকে অস্বস্তিতে ফেলিতে প্রায় কোনও রাষ্ট্রপ্রধানই সম্মত নন। অতএব বেজিংয়ের সাফ কথা: যাহা করিতেছি, বেশ করিতেছি।
ফলে ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে’ তিব্বতিদের প্রতি অনন্ত অবিচার চলিতেছে। তাঁহাদের কোনও স্বাধীনতাই অবশিষ্ট নাই। গিয়াছে। ক্রমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতিকে তিব্বতে বসত করাইয়া তিব্বতিদের নিজভূমে পরবাসী করিয়া দেওয়া হইতেছে। সামরিক বুটের তলায় নিষ্পেষিত এই স্বাধীন জনজাতির স্বাধিকারের ন্যায্য দাবিকে অবশিষ্ট বিশ্ব কূটনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়াছে। অসহায় তিব্বতিরা এই অবস্থায় কী করিবেন? কোন বিকল্প তাঁহাদের সামনে খোলা আছে? যে-জীবন মৃত্যুর অধিক, নিঃশেষ করিবার একটিমাত্র অধিকারই তো চিনা নিপীড়করা তাঁহাদের জন্য ছাড়িয়া রাখিয়াছেন। |