ভারতীয় ফৌজদারি বিধি (সংশোধিত) ২০১৩ অর্ডিন্যান্স-এ রাষ্ট্রপতির সিলমোহর পড়িল। যে দ্রুততার সহিত এই আইন-সংশোধনী সিদ্ধান্ত এবং লোকসভার পরবর্তী বৈঠক অবধি অপেক্ষা না করিয়াই অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাহা বলবৎ করিবার সিদ্ধান্ত দুইটি গৃহীত হইল, তাহা রীতিমতো বিস্ময়কর। গত ডিসেম্বর মাসে যখন দিল্লি গণধর্ষণ কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী দিল্লি স্তব্ধ করিয়া একটির পর একটি দিন জনসমুদ্র উত্তাল হইয়া উঠিতেছিল, সেই বিক্ষোভ-প্লাবনের অন্যতম বক্তব্য ছিল: এই সেই দেশ যেখানে কোনও প্রতিকারই সাধিত হয় না, কোনও সিদ্ধান্তই যথাসময়ে গৃহীত হয় না, ভয়ঙ্করতম অন্যায় ঘটিয়া গেলেও নৃশংসতম দুর্বৃত্তের কোনও উপযুক্ত সাজা হয় না। সেই দিক দিয়া দেখিতে গেলে, ঘটনার দেড় মাসের মধ্যে, সরকার-নিযুক্ত বর্মা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার মাত্র দশ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার তরফে পদক্ষেপ: এখনই অধ্যাদেশ পাশ করাইয়া এই আইনের পরিবর্তন সাধিত হইবে। ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে অধ্যাদেশ বিরল নহে। তবে ‘সামাজিক অপরাধ’ দমনের উদ্দেশ্যে এমন আপৎকালীন উদ্যোগ তুলনায় কমই দেখা গিয়াছে। ছয় মাসের মধ্যে পরবর্তী সংসদে অধিবেশনে অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করিতেই হয়। এই ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহেই যে হেতু পরবর্তী অধিবেশন, বাকি কাজটিও সম্ভবত দ্রুত সম্পন্ন করিবার চেষ্টা হইবে।
আপাতদৃষ্টিতে দ্রুততা ভাল। কিন্তু কোনও কিছুরই আতিশয্য বাঞ্ছনীয় নহে। এবং সেই জন্যই অধ্যাদেশ আনিবার ঘটনাটি যথেষ্ট বিস্ময়ও উদ্রেক করিতেছে বটে। মাসখানেকের মধ্যেই যেখানে সংসদীয় অধিবেশন আহূত হইবার কথা, সে ক্ষেত্রে নিয়মিত পদ্ধতিতে বিল আনিয়া আইন পাশ করা গেল না কেন? অধ্যাদেশ আনিবার মতো দুর্লভ সংসদীয় বিধির দ্বারস্থ হইতে হইল কেন? কীসের এত তাড়া? যে বিষয়ে এই আইন সংশোধিত হইতেছে, তাহা অত্যন্ত গুরুতর। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাই বিশেষ সতর্কতা জরুরি ছিল। বর্মা কমিটি যে সুচিন্তিত অভিমত দিয়াছে, সেগুলিও সমধিক গুরুতর, সেই অভিমতের বিবিধ অংশ লইয়া আরও ভাবনার আদানপ্রদানও অত্যন্ত জরুরি ছিল। এবং শেষত, যে হেতু বর্মা কমিটির প্রস্তাবসমূহের অনেকগুলিই এখানে গৃহীত হয় নাই, কিছু প্রস্তাব সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইতেও দেখা যাইতেছে, ফলে কমিটি রিপোর্টের সহিত অর্ডিন্যান্সের ব্যবধান কেন, তাহাও জনসমক্ষে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। এই সমস্ত স্তর ও ধাপ সটান পার হইয়া, আইন প্রণয়নের জন্য অপেক্ষা না করিয়া এক লাফে অধ্যাদেশের মতো চরমপন্থায় পৌঁছাইতে হইল কেন?
প্রশ্নটি গুরুতর। গোটা দেশে এই অতি-ত্বরিত অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে নারীবাদী সংগঠনগুলি প্রবল ক্ষুব্ধ: বিবাহোত্তর যৌন হিংসা তথা দাম্পত্য ধর্ষণকে এখানে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয় নাই, অথচ বর্মা কমিটি রিপোর্টে কিন্তু সরাসরি ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে নির্দিষ্ট হইয়াছিল। যৌনকর্মী সংগঠনগুলিও বিষম অপমানিত, প্রতিবাদে উত্তাল: নারীপাচার আটকাইবার নামে এই অধ্যাদেশ কার্যত সমগ্র যৌন-ব্যবসায়কেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করিতে চলিয়াছে। সঙ্গত প্রতিযুক্তি হিসাবে কেহ বলিতেই পারেন, যৌনব্যবসায় বেআইনি প্রতিষ্ঠিত হইলে কর্মীদের সামাজিক অসম্মান ও অনধিকার নিশ্চিত তো হইবেই, সঙ্গে সঙ্গে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া চোরাপাচার ও নারী-হিংসাও বর্ধিত হইবে। এই প্রতিযুক্তিগুলিও কিন্তু নারীর নিরাপত্তাসাধনের লক্ষ্যেই উৎক্ষিপ্ত। যুক্তি-প্রতিযুক্তির ধার না ধারিয়া, সেগুলির যথাযোগ্য বিচার না করিয়াই অর্ডিন্যান্স-এর ছক্কা-মার। বস্তুত অর্ডিন্যান্সটির মধ্যে যে প্রস্তাবগুলি রহিয়াছে, তাহাতে এই অনাবশ্যক তাড়াহুড়ার ছাপ বেশ স্পষ্ট। বর্মা রিপোর্টের কিছু প্রস্তাব বিবেচনাসাপেক্ষে বাদ দেওয়া যাইতেই পারে, কিন্তু বিবেচনার পদ্ধতিটিকেই তো বাদ দেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়! এত বড় সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকার কি শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অপদার্থতার দুর্নাম ঘুচাইবার কৌশলে পরিণত হইল? কাহার দিকে চাহিয়া এই অতি-ব্যস্ততা? নারীসমাজ? না ভোটার-সমাজ? |