শীতের রাতে এক আত্মীয়কে দূরপাল্লার ট্রেনে তুলে দিয়ে দিনের শেষ একটি লোকাল ট্রেনে আমি ও আমার এক বন্ধু বাড়ি ফিরছি। গন্তব্য চন্দননগর। একটা কামরাতে উঠে দেখি, পুরো ফাঁকা। কিছুক্ষণ বসার পর দেখি বছর চল্লিশের সুশ্রী এক ভদ্রমহিলা উঠলেন। পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণ। এর পর আরও দু’এক জন। ইতিমধ্যে ট্রেন ছাড়ল।
ভদ্রমহিলাকে দেখে আমাদের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কোনও অঘটন ঘটলে কী হবে কে জানে! চার দিকে যা সব ঘটনার কথা শুনি। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের শারীরিক অসুস্থতায় কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের বারান্দায় কয়েক বার রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা ছাড়া রাতের কলকাতায় বা রাতের হাওড়ায় রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে বিশেষ কিছুই নেই। শেষ ট্রেনে কবে বাড়ি ফিরেছি, তা-ও মনে করতে পারছি না। কলকাতায় যাতায়াতও কম। রাস্তাঘাটও ভাল চিনি না, জানি না। কলকাতায় যাওয়াটা যথাসাধ্য এড়িয়ে যাই। এই রকম অবস্থায় এই ভাবে রাতের শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরছি। সেই সময় হাওড়া-ব্যান্ডেল বা বর্ধমান লোকালে বা দূরপাল্লার রাতের গাড়িতে মাঝেমধ্যেই কোনও কোনও ঘটনার কথা কানে আসত। ভাবছি, সে রকম কিছু ঘটবে না তো! এই সব সাতপাঁচ ভাবছি বসে বসে। ভদ্রমহিলা অবশ্য বেশ শান্ত, নিশ্চিন্ত ভাবে বসে আছেন।
ট্রেন লিলুয়ায় ঢুকল। দু’এক জন হকার ভদ্রমহিলাকে দেখে খুব আন্তরিক ভাবেই ‘দিদি’ সম্বোধনে ডেকে বলে, দিদি, এটা খেয়ে নিন। কেউ কেউ বলে, দিদি এটা আপনার জন্য রেখেছি, নিয়ে যান। দিদি নিতে চায় না। সস্নেহে ফিরিয়ে দেয়। তারাও নাছোড়বান্দা। দেখে মনে হল, এই হকার ভাইদের সঙ্গে দিদির অনেক দিনের আলাপ। এর পর যত স্টেশন আসে, অনেক হকারই ওঠে। তাদের দিদির সঙ্গে দেখা করে অনেক সুখদুঃখের কথা বলে যায়। দেখে মনে হল, প্রায় সব হকারই তাদের প্রিয় ওই দিদিকে চেনে ও জানে। হকার ভাইয়েরা তাদের দিদির খোঁজখবর নেয়, দিদিও ভাইদের সারা দিন ব্যবসা কেমন চলল খোঁজ নিতে থাকে। উভয়পক্ষই বাড়ির খবর নিতে থাকে, কুশল বিনিময় করে। দিদিও সারাটা পথ ভাইদের সঙ্গে সারা দিনে ঘটে-যাওয়া ঘটনার গল্প জুড়ে দেয়। ইতিমধ্যে ভদ্রেশ্বর স্টেশন এলে দিদি হকার ভাইদের ‘আবার দেখা হবে’ বলে নেমে যায়। হকার ভাইরাও দিদিকে হাত নেড়ে জানায়, পরে আবার দেখা হবে।
ওই কথোপকথনে মনে হয়েছে, দিদি বিবাহিতা। তিনি সম্ভবত কোনও নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। বেশির ভাগ দিনই শেষ শো করে ওই ট্রেনেই বাড়ি ফেরেন। সম্ভবত তাঁর এক সন্তান শৈশবে বা কৈশোরে কোনও এক অঘটনে মারা যায়। নাটককেই পেশা করেছেন। হকার ভাইদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজের অন্তরের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ লাগিয়ে নেন। ভাইরাও দিদির এই রাত করে বাড়ি ফেরার সময় যাতে কোনও অঘটন না-ঘটে, তার দায়িত্ব নিয়েছে।
বাকি পথটা ভাবতে ভাবতে এসেছি, এই শীতের রাতে ওই হকারদের এই আচার-ব্যবহার ও আন্তরিকতা কোথাও যেন একটা পথ দেখাচ্ছে। এরা যদি মনে করে, যেখানে যা হচ্ছে হোকঅন্তত তাদের এই ব্যবসায়ের চলার পথে কোনও অন্যায়-অবিচার হতে দেবে না, তা হলে এরাই পারবে। আন্তরিক অভিনন্দন ও প্রণাম জানাই ওই হকার ভাইদের।
মলয় মণ্ডল। খলিসানি, হুগলি
|
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র বর্বর জাতি? |
কয়েক দিন আগে একটা বেসরকারি বাসে যাচ্ছিলাম। ভিড় ছিল না, অথচ একটা ছেলে এক দাঁড়ানো মহিলার পিছনে দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করছিল। মহিলা বিরক্ত বোধ করলেও সম্ভবত কিছু বলতে সাহস করছিলেন না। আমি জোরগলায় ছেলেটিকে বললাম, ‘এ দিকে অনেক জায়গা আছে, এ দিকে এসে দাঁড়াও’। তখনই সব মহিলা সাহস পেয়ে হইহই করে উঠলেন এবং ছেলেটি সুড়সুড় করে বাস থেকে নেমে গেল। কোনও পুরুষ যাত্রী কিন্তু সামান্য প্রতিবাদও জানাননি। বরং আমার উগ্র আচরণে পরোক্ষ ভাবে বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। এ রকম অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। বাস থেকে নামার পর এক পরিচিত বামপন্থী নেতা, যিনি বাসেই ছিলেন, বললেন, ‘‘সার, এই বৃদ্ধ বয়সে এ সব ঝামেলায় যাওয়ার কী দরকার? ওই ব্যক্তিকে বলেই বা কী লাভ? ‘পরিবর্তন চাই’ সরকারের জন্য মানুষ এমন হয়ে যাচ্ছে। আসুন না আমাদের সভায়, বক্তৃতা দিন।’’ |
গত নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে রাত সাড়ে দশটার সময় সিম কার্ড ফুরিয়ে যাওয়ায় সুনসান রাস্তা দিয়ে সিম কার্ডের দোকানে চলেছিলাম। ‘হাই’ শুনে তাকিয়ে দেখি নিউজিল্যান্ডের বছর পঁচিশের মেয়েটা, যার সঙ্গে হোটেলে আলাপ হয়েছিল। পরনে শুধু লঁজারি আর খুব ছোট শর্টস। দুরন্ত গরমে এটাই আরামদায়ক পোশাক। বললাম, ‘কোথায় যাচ্ছ!’ মেয়েটা বলল, ‘এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছি।’ ‘একা?’ ‘বন্ধু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ পথ চলতে চলতে প্রশ্ন করলাম, ‘এখানে মেয়েদের রাতে ঘোরা নিরাপদ?’ মেয়েটা হেসে বলল, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব শহরেই তো এ রকম পোশাকে রাতে নির্জন পথে ঘুরে বেড়িয়েছি। কই, কোথাও কোনও বিপদ তো হয়নি। শুনেছি তোমাদের কালকোট্টায় রাতে মেয়েরা বোরখা পরে না-বেরোলে বিপদ।’ বলে মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি মনে মনে বললাম, রাতে কেন কলকাতায় দিনের বেলা বহু লোকের মাঝখানেও এ পোশাকে বেরোলে হায়নারা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে।
আর বোরখা পরেও কি রেহাই আছে? মৌলানা আজাদ কলেজের কিছু বোরখা পরা ছাত্রীকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছি, বোরখা পরেও পথে-ঘাটে, বাসে, মেট্রোতে হেনস্থা ও অসম্মান থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। কলকাতায় দিনেও মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নেই। বছর কয়েক আগে একটি মেয়ে চশমার কাচ সারাতে বিকেলের দিকে আমহার্স্ট স্ট্রিট দিয়ে বউবাজারের দিকে চলেছিল। হঠাৎ একজন লোক তার হাত চেপে ধরে আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে বলে, সে কলকাতার সাদা পোশাকের পুলিশ। মেয়েটিকে ‘দেহোপজীবিনী’ অপবাদ দিয়ে একটা গলির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সৌভাগ্যজনক ভাবে দুর্বার সমিতির কয়েক জন ভদ্রলোক এসে পড়ায় সাদা পোশাকের পুলিশটি পালিয়ে যায় এবং মেয়েটি বেঁচে যায়। তা হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমরাই কি একমাত্র বর্বর জাতি?
রতনলাল বসু। প্রাক্তন অধ্যাপক, ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজ, কলকাতা-৫১ |