ভোটে ত্রিপুরা ব্যবহার-ধর্মেই দুর্গ রক্ষার
ধর্মযুদ্ধে ‘আমাগো’ সরকার
কাঁটাতারের সীমান্ত ঘেঁষা রাস্তা ধরে ঢুকছে একের পর এক ট্রেকার। পিলপিল করে লোক নামছে স্লোগান দিতে দিতে, ‘হিন্দু-মুসলিম কইত্যাছে, আমাগো সরকার আইত্যাছে’! একের পর এক মিছিলের ফাঁকে পথ চলাই দায়। তার মধ্যেই পথ চলছেন সরকার! মানিক সরকার!
সাদা কুর্তা-পায়জামা। গলায় সাদা চাদর মাফলারের মতো করে জড়ানো। পায়ে স্নিকার। কিছু দূরে গাড়ি রেখে ভিড়ের মাঝে রাস্তা করে নিয়ে এগোচ্ছেন মঞ্চের দিকে।
৭০ মিনিটের লম্বা বক্তৃতা। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলের সন্ত্রাস থেকে কী ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ত্রিপুরা, তার বর্ণনাই বেশি। কিন্তু প্রতি বিবরণের শেষে বলতে ভুলছেন না “কৃতিত্ব আমাদের না। কৃতিত্ব হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-উপজাতি সম্মিলিত মানুষের। তাঁরা সহযোগিতা না-করলে শুধু লাঠি-গুলি-বন্দুকের উপরে নির্ভর করে নিরাপত্তা বাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারত না।” সোনামুড়ার বক্তৃতা শেষ করে হন হন করে এগোতে যাবেন পরের মিটিংয়ের জন্য। হাত জড়িয়ে ধরলেন ধনপুরের গোপালচন্দ্র দাস। “চিন্তা করবেন না!” নিজের কেন্দ্রের বিধায়ককে অভয় দিলেন বৃদ্ধ গোপাল। আরও পথ পেরোতে হবে। বিদায় চেয়ে এগোলেন দেশের একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
রাতে আগরতলায় সিপিএমের রাজ্য দফতরে আনন্দবাজারের মুখোমুখি। কৃতিত্ব তা হলে তাঁর সরকারের নয়? গলাবন্ধের বোতাম আঁটতে আঁটতে মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, “আমরা কী করে করব? মানুষকে বলছি, আপনারা শান্তি ফিরিয়েছেন। এটাকে রক্ষা করতে হবে। মানুষের সহযোগিতা ছাড়া, তাদের নামাতে না-পারলে কিছু সম্ভব নয়।”
গোটা দেশের নজর তাঁর দিকে। একমাত্র বামপন্থী সরকারের আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারবেন তো? গোটা দল তাকিয়ে তাঁর দিকে। লোকসভা ভোটের আগে বামেদের মুখরক্ষা হবে তো? আর এই যাবতীয় চাপের মুখে মানিকবাবুর মোক্ষম অস্ত্র তাঁর সাধারণত্ব! নিজের বা সরকারের ঝুলিতে টুপিতে পালক না গুঁজে তিনি কৃতিত্ব বিলোচ্ছেন মানুষকে। লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি নেই। সভায় বলে এসেছেন, “মাছ-মাংস-ডিম রোজ খেতে না-পারলেও ডাল-ভাত খান। নিশ্চিন্তে থাকুন। কাজ করুন।” পরে সাক্ষাৎকারে বলেন, “ডাল-ভাত যারা খায়, তাদের মাছ-মাংস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে তো! কিন্তু সামর্থের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে চমক দেওয়ার জন্য কিছু কথা বলে পরে রক্ষা করতে না পারলে মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারব না!” অতএব, ‘স্বচ্ছ’ মুখ্যমন্ত্রীর স্ব-আরোপিত লক্ষ্মণরেখা “যা পারব না, তা বলব না। যা পারব, সতর্ক হয়ে বলব। যা বলব, তার চেয়ে বেশি করার চেষ্টা করব।”
মানিকবাবু বলার অনেক আগে ঠিক এই কথাটাই শোনা গিয়েছিল ধনপুরের আলি আকবরের মুখে। যিনি বলেছিলেন, “বামফ্রন্ট এখানে বারবার জিতছে, কারণ রয়েসয়ে বলে। যেটা পারবে না, বলে দেয়। অল্প অল্প করে এগোয়। কিন্তু উন্নয়নের কাজ হয়।” বলে রাখা যেতে পারে, মানিকবাবুর কেন্দ্র ধনপুর বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া। ও’পারের কুমিল্লা শহর মাত্র দশ কিলোমিটার দূরত্বে! এ’পারের ধনপুরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নেহাত কম নয়। গ্রামে গ্রামে পাকা রাস্তা, ঘরে ঘরে জল। ধনপুরের কংগ্রেস প্রার্থী শাহ আলম যদিও প্রশ্ন তুলছেন, বাম সরকার যদি এতই ভাল কাজ করেছে, তা হলে এত কম ভোটে জেতেন (২০০৮-এ তিন হাজারের কিছু বেশি ছিল ব্যবধান) কেন মুখ্যমন্ত্রী? তথ্য বলছে, ১৯৭৮ থেকে কখনও ধনপুরে হারেনি সিপিএম। প্রসঙ্গত, দলের তরফে মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র দেখভাল করার দায়িত্ব যাঁর উপরে ছিল, সেই শ্যামল চক্রবর্তী এ বার সোনামুড়া আসনে নিজেই প্রার্থী। মানিকবাবুর দায়িত্ব এ বার তাই কিঞ্চিৎ হলেও বেড়েছে।
কলকাতার সাংবাদিক পেয়ে সোনামুড়াতেই হাসান চৌধুরী বলেছিলেন, “আপনাদের ওখানে শুনেছি, লোকাল কমিটির সম্পাদককে ধরতেও লাইন দিতে হত! ওখানে সরকার থেকে চলে না-গেলে লাল ঝান্ডার ক্ষতি হয়ে যেত! এখানে এখনও ব্যবহারে কেউ হামবড়া হয়নি!” শুনে হাসছেন মানিকবাবু। “এটা আমাদের প্রতিদিনের লড়াই। নিজের মধ্যে, পার্টির মধ্যে। তা নইলে আর কমিউনিস্ট পার্টি কীসের?”
মুখ্যমন্ত্রীর আরও ব্যাখ্যা, “আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও! এটাই নেতাদের বলছি। নিজে কিছু না-করে অন্যকে উপদেশ দিলে তো চলবে না! জীবনযাপন, চালচলন ঠিক রাখতে হবে। ভাল ব্যবহার করতে অসুবিধার কি আছে? ব্যবহার জিনিসটা বাজারে কিনতেও পাওয়া যায় না।” নিজেই বলছেন, “আমার বিরুদ্ধেই যদি কেউ অভিযোগ নিয়ে আসে, আসুক না। লোকের কথা তো শুনতে হবে।”
এই দফায় বাম সরকারই চলছে ১৯৯৩ থেকে টানা। এত দিন ক্ষমতায় থেকেও দলের সব স্তরের লোক এই নীতি মাথায় রাখেন? হাসছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানাচ্ছেন, এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে কেউ যাচ্ছেন নজরে এলে চেষ্টা হয় বিরত করতে। বলছেন, “ক্ষমতা কোথায়? আমরা তো অন্যের বাড়ি পাহারা দিচ্ছি! ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। আমাদের হাতে ক্ষমতা, ভাবলেই তো হয়ে গেল!”
সাত রাজা কোনও দিনই ছিল না। যা ছিল বাংলা আর কেরলে, তা-ও এখন অস্তাচলে। বামেদের আছেন এক মানিক! তাঁকে আগলে আছে ধনপুর। যারা বুক বাজিয়ে বলতে পারে, “আমাগো একটাই সরকার!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.