|
|
|
|
ফতোয়ার জেরে পিছু হটল প্রগাশ |
থামল মেয়েদের গান, ক্ষোভে উত্তাল কাশ্মীর |
সাবির ইবন ইউসুফ • শ্রীনগর |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
রক্তপাত এবং হিংসাই তবে কাশ্মীরের শেষ কথা!
ঘৃণার রাজনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অশান্ত উপত্যকাকে সুর শোনানোর চেষ্টা করছিল যে গিটার, ইসলামি সংগঠনের ফতোয়া তাকে স্তব্ধ করে দিল।
‘প্রগাশ’-এর প্রথম প্রকাশেই চরম বাধা। ফতোয়ার জেরে পিছু হঠল তিন কাশ্মীরি কন্যা— নোমা নাজির, ফারা দিবা এবং অনিকা খালিদ। কাশ্মীর উপত্যকার প্রথম মেয়েদের রক গানের ব্যান্ড ‘প্রগাশ’-এর তিন সদস্য এরা। ডিসেম্বরেই প্রথম যাদের কণ্ঠ শুনেছিল কাশ্মীর। আর মাস দুয়েকের মধ্যেই তাদের সিদ্ধান্তআর গান নয়।
কারণ? জনসমক্ষে মেয়েদের গান করা যে ইসলামি মতাদর্শের পরিপন্থী। কাশ্মীরের প্রধান মুফতি বাসিরুদ্দিন আহমেদ-সহ বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসলামি সংগঠন বিষয়টির ঘোরতর বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। গত কাল এই মর্মে একটি ফতোয়াও জারি করেছিলেন বাসিরুদ্দিন। তাঁর বক্তব্য, “ইসলামের আদর্শ গান করাকে সমর্থন করে না।” অতএব অবিলম্বে তা বন্ধ করুক নোমা, ফারা এবং অনিকা। একই সঙ্গে ওই তিন কন্যার অভিভাবকদের প্রতি তাঁর ‘পরামর্শ’, আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি শিক্ষাও দেওয়া হোক তাদের। বাসিরুদ্দিনের আশঙ্কা, এই ধরনের গান কাশ্মীরে ইসলামি আদর্শকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। অতএব তা বন্ধ করাই বাঞ্ছনীয়।
প্রগাশ-এর গান বন্ধ করার সিদ্ধান্তে স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। মাথার উপর পাঁচটা ফতোয়া ঝুলছে বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। জানাচ্ছেন, “আমি ওদের গানের ভিডিও দেখেছি। |
 |
প্রগাশ-এর তিন সদস্য নোমা, ফারা এবং অনিকা। —নিজস্ব চিত্র |
নোমা নাজিরের কন্ঠ তো দুর্দান্ত। গায়কীও সুন্দর। কিন্তু যে ঘটনা ঘটল তা দুর্ভাগ্যজনক।” তসলিমার বক্তব্য, “এটা ঠিকই যে ইসলামে সঙ্গীতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্স্বাধীনতার কথা বলি, তখন গোটা বিষয়টি ফের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। রাজনীতিবিদদের ভেবে দেখতে হবে, কিছু অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ লোক যে সিদ্ধান্ত নেবে, তাকে এই একবিংশ শতাব্দীতেও গুরুত্ব দেওয়া হবে কি না।” তসলিমা মনে করেন তাঁর নিজের বই নিষিদ্ধ করা, সলমন রুশদিকে কলকাতায় আসতে না দেওয়া, কমলহাসনের ছবি নিষিদ্ধ করাএই সমস্ত ঘটনাই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত।
একই ভাবে এই ব্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়েছেন শোভা দে। আগেই টুইট করেছিলেন, “ সাংস্কৃতিক ‘ধমকিরাজ’ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।” পরে আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, “এর থেকেই প্রমাণ হয়, আজকের ভারতে এক দানবিক শক্তি কাজ করে চলেছে। প্রধান মুফতির এই ফতোয়া এখনকার মতো মেয়েদের ব্যান্ডটিকে স্তব্ধ করে দিল। কিন্তু এটা ওর এবং ওর মতো মানুষদের একটা তুচ্ছ জয়। মানুষের হৃদয়ের সঙ্গীতকে কে স্তব্ধ করতে পারে?” এটা খুবই লজ্জাজনক ঘটনা যে এই কিশোরীদের সঙ্গীতের মাধ্যমে নিজেদের ভাবপ্রকাশ করার ক্ষমতা বিসর্জন দিতে বাধ্য করা হল।” কাশ্মীরের গায়িকাদের মনোবল চাঙ্গা করতে তিনি তাদের গান চালিয়ে গিয়ে মৌলবাদীদের ‘মুখের মতো জবাব’ দেওয়ার কথাই বলছেন। সম্প্রতি কমলহাসনকেও একই ভাবে সমর্থন করে তিনি বলেছিলেন, “নির্বাসনে যাওয়া কোনও সমাধান নয়। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়তে হবে।”
প্রথম থেকেই প্রগাশ-এর পাশে ছিলেন খোদ জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। এ দিনও এক চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “জম্মু ও কাশ্মীর ধর্মনিরপেক্ষ জায়গা। এর গানের ঐতিহ্যও রয়েছে। ওরা গান করতে চাইলে সরকার সব রকম নিরাপত্তা দেবে।” একই সঙ্গে পরিষ্কার ভাবে জানান, বাসিরুদ্দিন সরকারের প্রতিনিধি নন।
বাসিরুদ্দিনের থেকে এখন দূরত্ব বাড়াতে চাইছে হুরিয়ত কনফারেন্সও। ফতোয়া জারির প্রশ্নে প্রথম দিকে হুরিয়ত কনফারেন্স এবং তাদের মতো একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে পাশে পেয়েছিলেন প্রধান মুফতি। এ দিন বাসিরুদ্দিনকে ‘রহস্যজনক’ আখ্যা দিয়েছে তারা। তাদের দাবি, তিন কিশোরীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি শুধুই সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার। বিষয়টি যে শুধুই ফতোয়া জারি, কিংবা পরামর্শ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা কিন্তু নয়। গত ডিসেম্বরে শ্রীনগরের ‘ব্যাটল অফ দা ব্যান্ডস’ প্রতিযোগিতায় প্রথম প্রকাশ্যে আসে প্রগাশ। এমনকী ছিনিয়ে নেয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও। তার পর থেকেই ইন্টারনেটে তীব্র সমালোচনা এমনকী হুমকিও পায় নোমা-ফারা-অনিকা।
এ ক’দিনে একটি ইতিবাচক ছবিও কিন্তু দেখছে কাশ্মীর। সে ছবি তিন আপাত সাধারণ কিশোরীর সমর্থনে তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে আসার। হয়তো তাই কাশ্মীর ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সমীর আহমেদ প্রশ্ন তুলেছেন, “রক ব্যান্ডে গান করার মধ্যে খারাপটা কী আছে?” একই সঙ্গে প্রগাশ-এর ত্রয়ীকে যারা হুমকি দিয়েছে, তাদেরও শাস্তির দাবি করেছেন সমীর।
কিন্তু এহ বাহ্য। ইতিমধ্যেই গানের জগৎ থেকে আস্তানা গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন কিশোরী। হয়তো আর কোনও দিনই শোনা যাবে না ভোক্যালিস্ট নোমা নাজিরকে। জনসমক্ষে ড্রাম বাজাবে না ফারা
দিবা। গিটারের তারে সুর তুলবে না অনিকা খালিদ।
প্রগাশ-এর আলো হিমশীতল উপত্যকায় হয়তো গুমরেই মরবে। |
|
|
 |
|
|