|
|
|
|
হুল্লোড় |
বারাসাতের ফুচকা হলিউডেও ভুলতে পারিনি
‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ থেকে ‘বিশ্বরূপম’। আমেরিকান টেলিভিশন থেকে টলিউড।
অভিনেতা-সুরকার সম্রাট চক্রবর্তীর মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
দু’টো বিতর্কিত ছবি।
দীপা মেটার ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’। কমল হাসনের ‘বিশ্বরূপম’।
রাহুল বসুকে বাদ দিলে সম্রাট চক্রবর্তী এক মাত্র বাঙালি অভিনেতা যিনি এই দু’টো ছবিতেই অভিনয় করেছেন। তবে সম্রাট সম্পর্কে বলতে গেলে শুধু এ দু’টো ছবিতেই আটকে থাকা যায় না। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে প্রায় আধ ডজন আন্তর্জাতিক টিভি শো। যার মধ্যে আছে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’, ‘থার্টি রক’, ‘ইন ট্রিটমেন্ট’-এর মতো শো। হলিউড বা ইন্ডি, হিন্দি ছবি হোক বা বাংলা তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে পাওয়া যাবে সবই। শুধু সিনেমা নয়, গানের প্রতিও তাঁর অদম্য টান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে বারাক ওবামার নির্বাচনী প্রচারের একটি ভিডিও তিনি পরিচালনা করেছেন কয়েক জন দক্ষিণ এশীয় অভিনেতার সঙ্গে। এরই মধ্যে সুর দিয়েছেন ‘বাম্বাগ’ বলে একটি মিউজিক্যালে। শ্যুটিং-এর জন্য কখনও বস্টন তো কখনও লস অ্যাঞ্জেলেস । পায়ের তলায় সর্ষে আছে তাঁর। কোন শহরে থাকেন তা ফেসবুকে বুঝিয়ে দেন প্লেনের বোর্ডিং পাসের ছবি তুলে। তাও ছোটবেলায় বারাসতে মামাবাড়িতে কাটানো দিনগুলো আজও তাঁকে খুব টানে। জানুয়ারির শেষের হালকা শীতে বিটনুন মাখিয়ে কুল খাওয়ার অভ্যেসটা আজও ছাড়তে পারেননি যে!
আজও ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে চোখ চকচক করে ওঠে তাঁর। বাবা কিষানলাল চক্রবর্তী পেশায় ডাক্তার। লন্ডন নিবাসী। ফাইন আর্টসের প্রতি টান চিরকালই। যাত্রা-নাটক এ সব অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তাঁদের পরিবারের। “প্রথমে লন্ডনে থাকতাম। তার পর কানাডা। বস্টন। এখন নিউ ইয়র্ক। আমেরিকান স্কুলে পড়া সত্ত্বেও প্রত্যেক রবিবার কিন্তু বাংলা শেখার জন্য একটা স্কুলে যেতাম,” সম্রাট বললেন। ছোটবেলায় করা যাত্রার গল্প করতে আজও মজা পান। “তখন আমরা বস্টনে। বাবা ঠিক করলেন ‘মুচিরাম গুড়’ যাত্রাটা পরিচালনা করবেন। অভিনেতারা নিজেরাই গান গাইবেন। সে এক কাণ্ড! আমার বয়স তখন সাত। বাবা বললেন যাত্রা দলের সঙ্গে আমাকে তবলা বাজাতে! ব্যস, আমি রাজি।” |
|
বস্টনে থাকার সময় রবিবারের মেনু ছিল খাঁটি বাঙালি। ভাত-ডাল-মাংস। আর বারাসতে থাকলে ছুটির দিনগুলোতে জমিয়ে ফুচকা খাওয়া। “হলিউডে বসেও বারাসতের হরিতলা মোড়ের ফুচকার স্বাদ ভুলতে পারি না। দাদামণির সঙ্গে গিয়ে খেতাম। আর দুপুরের ভাত খাওয়া হত কলাপাতায়। তার সঙ্গে ট্যাংরা মাছের পাতলা ঝোল। মাঝে মধ্যে গোলাপি রঙের রসগোল্লা। জাস্ট ফাটাফাটি!” পাড়া ফুটবলও চলত জমিয়ে। খালি পায়ে মাঠে নেমে পড়া। তার পর কাদা মাখামাখি।
কাট টু ২০১৩। এ বছরের শুরুতে তাঁর অভিনীত দু’টো ছবি ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ এবং ‘বিশ্বরূপম’। উভয় ক্ষেত্রেই বিতর্কের শেষ নেই। খারাপ লাগেনি তাঁর? “কী করব! হয়ত এটাই কপালে লেখা ছিল। দীপার বানানো ছবিগুলো খুবই সাহসী হয়। আমার অনেক দিন ধরেই ইচ্ছা ছিল ওঁর সঙ্গে ছবি করার। আবু ধাবিতে আমার ‘বম্বে সামার’ দেখে দীপা আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেন। ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’-এর উই উইলি উইঙ্কির চরিত্রটা আমাকে দেন।” আর সলমন রুশদি? “ওঁর লেখাগুলো ঐতিহাসিক ভাবে খুবই প্রাসঙ্গিক। ওঁর রসবোধ অসাধারণ। সেটা লেখার মধ্যেও প্রকাশ পায়।”
সলমন রুশদির রসবোধের কথা বলতে গিয়ে বললেন, এক বার তাঁদের দু’জনের গল্প হচ্ছিল রুশদির বিরুদ্ধে জারি হওয়া ফতোয়া নিয়ে। সেই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রুশদি বলেন যে, এই ফতোয়ার খবরটা যখন আসে তখন উনি নিজের বাড়িতে। মিডিয়ার কেউ একজন তাঁকে ফোন করে খবরটা জানিয়েছিলেন। রুশদির ভাষায়,“খবরটা শুনে আমি যা করেছিলাম, সেটা খুবই হাস্যকর। শোনামাত্র আমি উঠে গিয়ে বাড়ির সদর দরজাটা বন্ধ করে দিই। যেন সেটা করলেই আমার সুরক্ষার সব ব্যবস্থা হয়ে গেল!” সম্রাট বললেন,“এটাই হচ্ছে রুশদির বিশেষত্ব। খুব সিরিয়াস অবস্থাতেও উনি এমন ভাবে কথা বলেন, যে পরিস্থিতি নিমেষে হালকা হয়ে যায়। একাই পার্টি জমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন! ওঁর সংস্পর্শে থাকতেও ভাল লাগে।”
নিজের দুই প্রিয় ব্যক্তিত্ব সলমন রুশদি এবং কমল হাসন, সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হওয়াতে খুবই আঘাত পেয়েছেন সম্রাট। বললেন,“খুব খুশি হতাম যদি সলমন কলকাতাতে আসতে পারতেন। আসতে পারেননি জেনে খারাপ লেগেছে। তবে আমি খুশি যে এতে উনি দমে যাননি।”
কমলের ব্যাপারে বললেন যে উনি তো ‘চ্যাপলিন অফ দ্য ইস্ট’! “সমস্যাটা হল, মানুষ গতানুগতিকতার বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। এটা শুধু কলকাতা বা ভারত বলে নয়, সর্বত্রই। এমনকী আমেরিকাতেও একই সমস্যা। আসলে যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তারা সব সময় ক্ষমতা হারানোর ভয় পায়। তাই যারা একটু অন্য রকম কিছু বলে বা করে তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লাগা হয়।”
সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসবাদ চালানোর পদ্ধতিটা সারা বিশ্বেই সমান। “শুধু শিল্পের ক্ষেত্রেই কেন বলব? সাধারণ জীবনযাত্রাতে। এমনকী অফিসের চৌহদ্দির মধ্যেও। একটু আলাদা হলেই একঘরে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। প্রয়োজনে আপনার পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হবে। বা অবুঝ জনতা। যা হোক একটা অভিযোগ আনা হবে। খুব অল্প মানুষই থাকেন, যাঁরা রুশদির মতো লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন।”
সম্রাটের নিজের পক্ষে আমেরিকাতে অভিনয় জগতে কাজ করাটা খুব সহজ ছিল না। “হলিউডের ছবিতে ‘ব্রাউন ওয়ালপেপার’ হওয়ার আমার কোনও ইচ্ছা ছিল না। আমার সৌভাগ্য যে আমেরিকাতে ছোট পর্দার সঙ্গে সঙ্গে বড় পর্দাতেও নানা ধরনের কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।” ‘ইন ট্রিটমেন্ট’-এ করা তাঁর নিজের চরিত্রটি খুব প্রিয়। সেখানে তাঁর সহ-অভিনেতা ছিলেন ইরফান খান আর অস্কার বিজয়ী গ্যাব্রিয়েল ব্রায়েন। “ইরফান আমার বাবার চরিত্রটি করেছিলেন। আমি অভিনয় করেছিলাম কলকাতার এক বাঙালির চরিত্রে, যে মা মারা যাওয়ার পর তার বাবাকে নিয়ে পশ্চিমে চলে যায়। ইরফানের চরিত্র হতাশায় ভুগতে শুরু করে। আর গ্যাব্রিয়েল কাউন্সেলিং করে তার। এইচবিও-তে এই শো-টা সত্যিই দারুণ ছিল। ভারতীয়রা কী ভাবে আমেরিকানদের সঙ্গে মিশে গিয়েছে সেটাই দেখানো হয়েছিল।” |
আমি |
• জন্ম: ২২ অগস্ট, লন্ডন
• রিলেশনশিপ স্টেটাস: সিঙ্গল
• হোটেলের রিসেপশনে নিজের পরিচয়ের জায়গায় লিখি গেছোদাদা। ওটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ থেকে।
• ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’-এ ঘুমপাড়ানি গানে সুর দিয়েছি। এর আগে ‘লয়েন্স অব পঞ্জাব প্রেজেন্টস’-এও সুর দিয়েছিলাম। পিয়ানো বাজাতে ভালবাসি।
• কলকাতায় ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’-র শ্যুটিং করার সময় আমার সহ-অভিনেত্রী হলিউডের রাধা মিশেলকে পার্ক স্ট্রিট বাই নাইট দেখিয়েছিলাম। রাধা ভারতে এসে আবার ছবি করতে চায়। নাম ‘হোলি কাউ’। আমাকে তাতে অভিনয়ও করতে বলেছেন।
• এ বছরের অস্কার নমিনি জোয়েল এডগার্টনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কলকাতায় ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’ শ্যুটিং-এর সময়। শ্যুটিং-এর ফাঁকে দু’জনে মিলে প্রায় রাতেই কলকাতার সব ডিস্কে যেতাম। |
|
হলিউডি অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের সঙ্গে ‘থার্টি রক’ শো-তে অভিনয় করেছিলেন তিনি। “ওখানে বল্ডউইন অভিনয় করেছেন আমার বসের ভূমিকায়। কিন্তু আমি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করিনি। দুর্ধর্ষ কমেডি হয়েছিল ওটা। সামনের মাসে শুরু হবে ‘জিরো আওয়ার’। আর আছে ‘ড্যামেজেস’। হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্লেন ক্লোসের সঙ্গে অভিনয় করছি সেটাতে। আধ্যাত্মিক গুরুর চরিত্রে। ”
আমেরিকাতে ভারতীয় অভিনেতাদের অবস্থা কি সত্যিই বদলাচ্ছে? “বদলটা ধীরগতির। ভারতীয় অভিনেতারা সচরাচর দ্বি-মাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন। স্ক্রিনে কত জন ভারতীয় অভিনেতাকে দেখেন হলিউডি কোনও অভিনেত্রীকে চুমু খেতে? বোধহয় একজনকেও না। সেন্ডিল রামমূর্তি, আজিজ আনসারি, কাল পেনরা আছেন। কিন্তু যে সব চরিত্রে তাঁদের নেওয়া হয়, তাতে আমেরিকায় ভারতীয় অভিনেতাদের বাস্তব অবস্থা বোঝা যায় না।”
আর সাউথ এশীয় অভিনেত্রীরা? ‘‘ওদের তো দেখা হয় ‘এক্সোটিকা’ হিসেবে। একমাত্র মিন্ডি কেলিংই কিছু করেছেন। ‘অফিস’ নামে একটা হিট সিরিজ হয়েছিল। মিন্ডি লিখেছিলেন ওটা। আর নিজের কথা ভেবে একটা জিপসি ধরনের চরিত্রও লিখেছিলেন। এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে এখন ওঁর নিজের নামেই আমেরিকায় একটা শো চলে। নাম ‘দ্য মিন্ডি প্রোজেক্ট’। প্রথার ভিতরে থেকে কী ভাবে তা পাল্টানো যায় মিন্ডি সেটা দেখিয়েছেন।”
এখনও সম্রাটের সামনে রয়েছে পাঁচ-পাঁচটা ছবির কাজ। আমেরিকান সিনেমার পাশাপাশি রয়েছে ভারতীয় আর একটা ব্রিটিশ প্রোডাকশন। “আমার আগামী ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘এক্সটিংশন’, ‘ব্লেমিশড্ লাইট’, ‘বিয়ন্ড দ্য মাস্ক’, ‘স্ট্রিপড্’, এবং ‘ফারা গোজ ব্যাং’। শ্যুটিংয়ের জন্য কলকাতায় ফিরে আসতে খুব ভাল লাগে। সুমন ঘোষের ‘দ্বন্দ্ব’তে অভিনয় করেছিলাম। করেছি ‘বং কানেকশন’ আর ‘পিয়ালির পাসওয়ার্ড’। ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম হলিউডি অভিনেত্রী রাধা মিশেলের সঙ্গেও। বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন কিছু করার আনন্দই আলাদা,” বললেন সম্রাট।
নিজের পথচলা শুরু করেছিলেন বাবার পরিচালনায় ‘হ য ব র ল’ দিয়ে। সুকুমার রায় আর সাত সমুদ্র পেরিয়ে সম্রাট আজও শিকড়ের টানে ফিরতে চান কলকাতায়। |
|
|
|
|
|