মানসিক অসুস্থতার জন্য কলকাতার লুম্বিনী মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল শিখা চক্রবর্তীকে। চিকিৎসার পরে ডাক্তারবাবুরা তাঁকে সুস্থ ঘোষণা করে দিয়েছেন বহু দিন হল। তবু বছর পঁয়তাল্লিশের ওই মহিলাকে ফিরিয়ে নিতে চাননি বনগাঁর বাড়ির লোক। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে
ব্যর্থ হয়েছেন।
অগত্যা গত পনেরো বছর ইস্তক হাসপাতালের একটি শয্যায় দিন কাটছে শিখাদেবীর।
উনি একা নন। পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি সরকারি মানসিক হাসপাতালে ঘুরলে এমন অনেক শিখা, বিভাস বা মানসীর দেখা মিলবে। সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও দশ বছর, পনেরো বছর ধরে হাসপাতালই যাঁদের ঠিকানা। স্বাস্থ্য দফতরের তথ্যানুযায়ী, পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে এঁদের সংখ্যাটা অন্তত পাঁচশো। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে শয্যার নিত্য সঙ্কট সত্ত্বেও পাঁচশোটি বেড অযথা বছরের পর বছর আটকে রয়েছে, অথচ নতুন রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না। দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের সরকারি পাঁচটি মানসিক হাসপাতালে বছরে অন্তত তিন হাজার রোগীর ভর্তি হওয়ার কথা (মোট ৭৮৩টি শয্যায় বছরে গড়ে চার জন হিসেবে)। সেখানে কোনও বছর ভর্তি করা যাচ্ছে সাকুল্যে পাঁচশো জনকে, কোনও বছর আরও কম।
সমস্যার কোনও সুরাহা নেই?
অনর্থক শয্যা আটকে থাকা এই ধরনের ‘প্রাক্তন’ রোগীদের পুনর্বাসন দিয়ে শয্যা খালি করার পরিকল্পনা নিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সাইকিয়্যাট্রিক রিহ্যাবিলিটেশন অফ ইনপেশেন্টস অফ মেন্টাল ইলনেস।’ ঠিক হয়েছিল, সমাজকল্যাণ দফতর ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত হোমগুলোয় ওঁদের রাখা হবে। ওঁদের থাকা-খাওয়ার পুরো খরচ স্বাস্থ্য দফতর জোগাবে, রক্ষণাবেক্ষণ-নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন হোম-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হুগলির গুড়াপ হোম-কাণ্ডের জেরে প্রকল্পটি কার্যত ভেস্তে যেতে বসেছে। কী রকম?
গুড়াপের হোমটিতে গুড়িয়া নামে এক আবাসিকার রহস্যজনক মৃত্যু ও মেয়েদের নিখোঁজ হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরে সার্বিক ভাবে হোমগুলির নিরাপত্তা ও পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। বস্তুত তদন্তে ধরা পড়েছে, অধিকাংশ মহিলা হোমে আবাসিকদের সুরক্ষা বলতে প্রায় শূন্য। ছেলেদের বহু হোমেও খাবার-দাবার, দেখভালের হাল শোচনীয়। পড়াশোনা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের বালাই প্রায় কোথাও নেই। তাই হোম-পালানোর ঘটনারও অন্ত নেই।
এ হেন পরিস্থিতিতে সমাজকল্যাণ দফতর সুস্থ হয়ে ওঠা মানসিক রোগীদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়। সমাজকল্যাণ কমিশনারের অফিসের কর্তারা স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের ১৮টি হোমের একটিও মানসিক রোগীদের জন্য নয়। মানসিক ভাবে অসুস্থ ভবঘুরেদের জন্য দফতরের যে দু’টো হোম, তারও অবস্থা তথৈবচ। গুড়াপ-কাণ্ডের পরে সেখানে নতুন আবাসিক নেওয়া বন্ধ, কারণ সবার আগে হোমের পরিকাঠামোর আমূল সংশোধন জরুরি বলে সমাজকল্যাণের কর্তারা মনে করছেন।
স্বাস্থ্য দফতরও জোর করতে পারছে না। “হাসপাতাল থেকে দূরে অবস্থিত ওই সব হোমে আবাসিকদের সঙ্গে কী করা হচ্ছে, কী পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে, তা সব সময় নজরে রাখার মতো ক্ষমতা আমাদেরও
নেই। কোনও অঘটন ঘটলে
কী হবে?” মন্তব্য স্বাস্থ্য-মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের।
ফলে মানসিক হাসপাতালে আটকে থাকা শয্যাগুলো আদৌ খালি করা যাবে কি না, তার উপরে চেপে বসেছে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন। উপায়ান্তর না-দেখে দিন কয়েক আগে পুনর্বাসন সংক্রান্ত খসড়া নিয়ম তৈরি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। তাতে বলা হয়েছে, চারটি মানসিক হাসপাতালে (পাভলভ, লুম্বিনী, বহরমপুর ও পুরুলিয়া) পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু সে জন্য হাসপাতাল ভবন সংস্কার করতে হবে, কিনতে হবে নতুন আসবাবপত্র। যার খরচ কয়েক লক্ষ টাকা। ‘টানাটানি’র সংসারে সরকারি নিয়ম-বিধির জট ছাড়িয়ে পরিকল্পনাটি কবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে স্বাস্থ্য-কর্তারাই ঘোরতর সংশয়ে। রাজ্যে চারটি মানসিক হাসপাতালের অধীনে ছ’টি ‘হাফওয়ে হোম’ তৈরিরও প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়। বাড়ি ভাড়া নিয়ে বা হাসপাতাল চত্বরে বাড়ি বানিয়ে এগুলো করা যেতে পারে। অথবা হাসপাতাল লাগোয়া এলাকায় জমি নিয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু ঘটনা হল, অধিকাংশ হাসপাতালেই জায়গা-সঙ্কট। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াতেও বিস্তর জটিলতা।
ফলে শিখা-বিভাস-মানসীদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর আশা এই মুহূর্তে বহু দূর।
|