পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক পুনর্গঠনে ৪০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি)। তার পাশাপাশি ‘শিলিগুড়ি করিডর’-এর পরিকাঠামো উন্নয়নেও এই সংস্থা আর্থিক সাহায্য করতে উৎসাহী। এডিবি-র প্রেসিডেন্ট হারুহিকো কুরোডা বলেন, “ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানো প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বাণিজ্য বাড়াতে শিলিগুড়ি করিডরের উন্নতি প্রয়োজন।” সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, “যোগাযোগ ব্যবস্থায় বর্তমান পরিকাঠামো যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগেরও অভাব রয়েছে। তা মেটাতে বিদেশি সাহায্য দরকার। যার মধ্যে এডিবি-র সাহায্য অন্যতম।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আর্থিক পুনর্গঠনে ৪০ কোটি ডলার ঋণ দিলেও বেশ কিছু শর্ত চাপিয়েছে এডিবি। তার মধ্যে রয়েছে, কর কাঠামোর সংস্কার করে আয় বাড়ানোর কথা। অহেতুক খরচও কমাতে বলা হয়েছে। ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষের মধ্যে ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন ফি, উৎপাদন শুল্ক, পেশাগত কর বাবদ রাজস্ব আয় কোথায় কত বাড়াতে হবে, তা ঋণ চুক্তিতে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী জনমোহিনী রাজনীতির পথে হেঁটে একের পর এক ঘোষণা করেছেন, যাতে চাপ বেড়েছে রাজকোষের উপরেই। এই অবস্থায় এডিবি-র শর্ত, খরচ কমাতে সরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ কমিয়ে বেতন-পেনশন বাবদ আর্থিক দায় কমানোর পথে হাঁটতে হবে রাজ্যকে।
ভারতে এডিবি-র কান্ট্রি ডিরেক্টর হুন কিম বলেন, “আমরা রাজ্য সরকারের সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করি। উদ্দেশ্য হল, আর্থিক স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি। এডিবি-র শর্তগুলির মধ্যে রাজ্য সরকারকে কর ফাঁকি রুখতে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের কথা বলা হয়েছে। সম্পত্তি কর ব্যবস্থার সরলীকরণ, পণ্য পরিবহণকারী গাড়িগুলির থেকে কর আদায়ের সময় ‘বারকোডিং’ ব্যবস্থা চালু করার কথাও চুক্তিতে রয়েছে।” সেই সঙ্গেই কিম বলেন, “আমরা চাই, রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ুক। কর আদায় ব্যবস্থা আধুনিক হোক। এতে রাজ্য সরকারেরই দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে।”
এডিবি-র দাবি, এই সব শর্ত চাপানোর মূল উদ্দেশ্য হল, রাজ্য যাতে নিজের আর্থিক স্বাস্থ্য মজবুত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে এবং ঋণ পরিশোধ করার অবস্থায় থাকে। এডিবি-র প্রেসিডেন্ট একে রাজ্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন না। আজ দিল্লিতে তাঁর ব্যাখ্যা, “পশ্চিমবঙ্গের মতো পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিকে আমরা সাহায্য করছি। তবে আমরা আইএমএফ (আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার) নই। আমরা একটা উন্নয়ন ব্যাঙ্ক। কোনও নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য বা কোনও নীতি রূপায়ণের জন্য আমরা ঋণ দিয়ে থাকি। রক্ষাকবচ হিসেবে কিছু ন্যূনতম শর্ত দেওয়া হয়। শর্তগুলি যতটা সম্ভব কম রাখা হয়, যাতে ওই সব প্রকল্প বা নীতি রূপায়ণ করা সম্ভব হয়।”
রাজ্যের বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে মমতা নিত্যদিনই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করছেন। কখনও কেন্দ্রের কাছে সাহায্য চাইছেন। কখনও হুমকি দিচ্ছেন। এডিবি-র কর্তারা বলছেন, এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রাজ্য সরকারকে আগামী দিনে উন্নয়ন খাতে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার জন্য সক্ষম হয়ে উঠতে হবে। কিমের বক্তব্য, “আমাদের চেষ্টা হল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোর উন্নয়নের প্রয়োজনে রাজ্য সরকার যাতে আরও ঋণ নিতে পারে, সেই জায়গাটা তৈরি করে দেওয়া। এর জন্যই আমরা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছি।”
ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগের এক মাত্র রাস্তা শিলিগুড়ি করিডর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য বাড়াতে তাই শিলিগুড়ি করিডরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন এডিবি-র কর্তারা। তাঁদের মতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়লে এশিয়ার সব অঞ্চলেরই আর্থিক উন্নতি হবে। তাতে সবথেকে বেশি লাভবান হবে ভারত। সেই কারণেই পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এখন এডিবি ভারতকে বছরে ২০০ কোটি ডলার আর্থিক সাহায্য দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এডিবি-র কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, “২০১২ থেকে ২০১৭, এই পাঁচ বছরে ভারতকে ১২০০ কোটি ডলার আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে।” এর মধ্যে থেকেই শিলিগুড়ি করিডর-সহ সংলগ্ন অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়নে কী ধরনের প্রকল্প নেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। |