মুখোমুখি ১...
ফাইট সৌমিত্র ফাইট
পত্রিকা: শর্মিলা ঠাকুর পদ্মভূষণ পেলেন। শুভেচ্ছা জানালেন?
সৌমিত্র: না, এখনও টেলিফোন করা হয়নি। করার ইচ্ছে আছে এক বার। তা না হলে দেখা হলে জানাব। আমাদের তো মাঝে সাঝে দেখা হয়ই।

পত্রিকা: কেমন লাগল খবরটা পেয়ে?

সৌমিত্র: খুব খুব খুশি হয়েছি আমি। আমরা তো সেই ‘অপুর সংসার’ দিয়ে একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলাম। তার পর ও মুম্বই চলে গিয়ে কাজ করতে করতে শীর্ষে পৌঁছাল। আর আমি আমার মতো কাজ করতে লাগলাম বাংলা ছবিতে। পুরস্কারের খবরটা পাওয়ার পর ওর কেরিয়ারগ্রাফটার কথা মনে পড়ছিল। শর্মিলার সঙ্গে যেসব ছবিতে অভিনয় করেছি, সেগুলোর কথাও। সিনেমায় হাতেখড়ির দিন থেকে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। তখন থেকেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। এখনও সেই বন্ধুত্ব অটুট। দেখা হলে কত কথা যে হয়!

পত্রিকা: গত মাসেই জন্মদিন পেরিয়ে এলেন। এ বছরের জন্মদিনে রেজোলিউশন কী নিলেন?

সৌমিত্র: জন্মদিন বলে আলাদা করে রেজোলিউশন কেন! বছরের অন্য দিনগুলোতে কোনও রেজোলিউশন নেই?

পত্রিকা: তার মানে জন্মদিনকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়াটা ...

সৌমিত্র: আমার জন্মদিনটা গুরুত্বপূর্ণ অন্যদের কাছে। যারা আমার জন্মদিনটা মনে রাখে বা তাই নিয়ে কোনও উৎসব করে। এর মানে যে আমার নিজের জন্মদিনটা আমাকে খুব উচ্ছ্বসিত করত না তা নয়। তবে সে অনেক দিন আগের কথা।

পত্রিকা: সারা বছরের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো কী কী তা হলে?

সৌমিত্র: নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়ের জন্মদিন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া নতুন নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিনটা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সে সব দিনের উত্তেজনা, উদ্বেগ এবং প্রত্যাশাই আলাদা।

পত্রিকা: আর ছবি রিলিজের দিনটা?

সৌমিত্র: সে অনেক আগে ছিল। এখন আর নেই। ছবি কবে রিলিজ হয় তাই জানি না। মনেও রাখি না।
পত্রিকা: অনীহা?
সৌমিত্র: অনীহা তো নয়। এখন এমন কোনও ছবিতে অভিনয় করি না যেটা নিয়ে আগ্রহ থাকে। শেষ মনে পড়ে যখন তপনদার (তপন সিংহর) ছবিতে অভিনয় করছি সেই সময় একটা আগ্রহ ছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি ‘হুইলচেয়ার’ করার সময় মনে হয়েছে, এত দরদ দিয়ে করা একটা ছবি, এত সুন্দর একটা রোল পেয়েছি এই বয়সে, সেটা কী রকম ভাবে মানুষ নেবে। কিংবা ২০০১য়ে যখন গৌতম ঘোষের ‘দেখা’ করেছি, আগ্রহ ছিল।

পত্রিকা: আরেকটু যদি পিছিয়ে যাই। ’৮০ সাল। তখন উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আগে দুটো ঘোড়া দৌড়াত, এর পর থেকে একটা ঘোড়া দৌড়াবে ...

সৌমিত্র: ওটা আমার মুখে বসানো হয়েছিল। ওই ভাষায় আমি কথাই বলি না। ও বাংলা আমার নয়। আমার মনের ভাষাও ওরকম নয়। তা ছাড়া আমি দৌড়ে তো বিশ্বাস করি না। আর ঘোড়দৌড়ে তো আরও বিশ্বাস করি না। যখন সেই ইন্টারভিউটা বেরিয়েছিল আমি খুব রিঅ্যাক্ট করেছিলাম। আমি হয়তো বলেছিলাম যে আগে দু’জনের মধ্যে বেশ একটা প্রতিযোগিতা থাকত, এখন আর সেটা রইল না। হয়তো সেই কথাটাই সাংবাদিক ঘোড়দৌড়ে নিয়ে গেলেন।

পত্রিকা: দৌড়ে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আপনার ‘তৃতীয় অঙ্ক অতএব’ নাটকে ‘দে ছুট দে ছুট দে ছুট’ এই সংলাপ কিন্তু বারবার ফিরে আসে...

সৌমিত্র: সে ছোটা তো অন্য রকম। তার মানে ‘রেস’ নয়। নানা রকম ভাবে ‘দে ছুট’ কথাটা আসে। আনন্দের জন্য আসে, আবার পালানোর জন্যও আসে। নাটকের একটা সংলাপ আছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ছোটা মানে তো কেবল মৃত্যু থেকে পালানো নয় বা বিপদ থেকে পালানো নয়। জীবনের নিজস্ব একটা দৌড় আছে। জীবনকে উপভোগ করতে করতেই তো দৌড়োনো।

পত্রিকা: তা হলে জীবন মানে পথ হাঁটা নয়। শুধুই দৌড়?

সৌমিত্র: কে বলেছে পথ হাঁটাই একমাত্র জীবন? জীবন মানে লাফানোও তো হতে পারে। জীবন মানে শুধু হাঁটা এটা আমি বিশ্বাস করি না।

পত্রিকা: আপনি গতিতে এত বিশ্বাস করেন। আপনাদের যৌবনের তুলনায় আজকের সময় তীব্র গতিশীল। তা হলে কি আজকের সময়ের সঙ্গে বেশি রিলেট করতে পারেন আপনি? আগেকার দিনের ধীর-মন্থর গতিটা ভাল লাগত না?

সৌমিত্র: জীবনের হাঁটা হোক বা দৌড়োনো, লয়ের তফাত তো হয়ই। জীবন যখন যে রকম ভাবে অ্যাকসেপ্ট করেছি। আজকের এই দ্রুত গতির জীবনেও আমি বেমানান নই। বরং বলা যায় বেশ মানানসই।

পত্রিকা: জিরোতে ইচ্ছে করে না?

সৌমিত্র: এখন এই বয়সে এসে শারীরিক ভাবে জিরোবার দরকার মনে করি। মানসিক ভাবে কোনও বিশ্রামের কথা ভাবি না। কাজকর্মের জন্য যেটুকু বিশ্রামের দরকার পড়ে, সেইটুকুুই।

পত্রিকা: এত এনার্জি কোথা থেকে পান ...

সৌমিত্র: না-চলা মানেই থামা। থামা মানেই আমার কাছে মৃত্যু। বিবেকানন্দও তাই বলেছিলেন। সেই শিক্ষা থেকেই চলি।

পত্রিকা: থামার কথা নয়, জীবনে থমকে যাওয়ার ঘটনা... এই ধরুন, বিশ্বাসভঙ্গ হওয়া?

সৌমিত্র: হঠাৎ বিশ্বাসভঙ্গের কথা কেন!

পত্রিকা: আপনার ‘কিং লিয়র’-এর কথা মনে পড়ছে। জীবনে লিয়রের মতো আপনিও কি অনেক বিশ্বাসভঙ্গের মুখোমুখি হয়েছেন?

সৌমিত্র: বহু বার। কিন্তু কোথায় কখন কী ভাবে, সেসব মনে রাখিনি। ওসব মনে রেখে কী হবে? চলতে চলতে গেলে মানুষের সঙ্গে মানুষের আদানপ্রদান হয়, জান পহেচান হয়, কত রকমের কত কমিটমেন্ট মানুষ করে ফেলে। ধরুন, একটা সমিতির মধ্যে আমি ঢুকলাম। তার পর সেই সমিতির কাজে আমার আস্থা রইল না। সেও তো বিশ্বাসভঙ্গ হওয়া। তবে লিয়রের মতো বিশ্বাসভঙ্গের মুখোমুখি কখনও হইনি। কোনও প্রত্যক্ষ ফটোগ্রাফিক প্রভাব নেই। জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, জীবন সম্পর্কে বোধবুদ্ধি, সেগুলোই ঘুরে ফিরে এসেছে লিয়রে।

পত্রিকা: এখনকার বাংলা ছবি কতটা দেখেন?

সৌমিত্র: খুব একটা বাংলা ছবি দেখি না। বেশির ভাগ বাংলা ছবি সম্পর্কে সেই কৌতূহলটাই অনুভব করি না।

পত্রিকা: বছর কয়েকের মধ্যে বহু আলোচিত অন্তত দুটো ফিল্মের কথা বলব। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’ বা গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’। তা’ও দেখেননি?

সৌমিত্র: হ্যাঁ দেখেছি। আমার বেশ ভালই লেগেছে। আর দেখেছি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। প্রথম দশ মিনিট বাদ দিলে ছবিটা বেশ মজার। এই রকমই হওয়া উচিত কমার্শিয়াল ছবি। মাঝখানে যে কেবল দক্ষিণী ছবির থেকে নকল হচ্ছিল, সেই ঝোঁকটা কিছুটা হলেও থেমেছে।

পত্রিকা: এখনকার প্রসেনজিৎকে কেমন লাগছে?

সৌমিত্র: আগের চেয়ে অনেক ডেভলপ করেছে। ভাল লাগছে সেটা। তবে আগেও ও ছবিতে নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পরিশ্রম আর যত্ন করে কাজ করত। সেটা আমি বরাবরই অ্যাপ্রিসিয়েট করি।

পত্রিকা: কেন তবে বলছেন বাংলা ছবি দেখার কৌতূহলটা চলে গেছে?

সৌমিত্র: আগেও কৌতূহলটা ছিল বলে মনে পড়ে না। যে ছবিটা শুনতাম ভাল হয়েছে, সেটাই দেখতাম। বা খুব বড় ডিরেক্টর হলে তার নাম শুনে দেখতে যেতাম। সত্যজিৎ রায়ের ছবি, তপন সিংহের ছবি আমি অভিনয় করি বা না করি, দেখতে ইচ্ছে হত। সেই কৌতূহল জাগানোর মতো ডিরেক্টর কেউ নেই। এটা পরিষ্কার বলাই ভাল।

পত্রিকা: কারও মধ্যে কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না?

সৌমিত্র: না, কারও মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। যাকে দেখে মনে হবে ‘পথের পাঁচালী’ করলেও করতে পারে।
পত্রিকা: ইদানীং কিন্তু বাংলা ছবি দেখার জন্য লম্বা লাইন পড়ছে। তা ছাড়া ‘পথের পাঁচালী’ করাটাই কি ভাল ছবি করিয়ে হওয়ার সব চেয়ে বড় মানদণ্ড?
সৌমিত্র: মানদণ্ড না হলেও ল্যান্ডমার্ক তো বটেই। আজকালকার কোনও কোনও সিনেমা বিজ্ঞাপনের ছবির মতো। গত পনেরো বছরে বাংলায় একটা ‘কহানি’র মতো ছবি হল না। তবে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে আমি যেমনটা চাই, তার আমেজ খানিকটা অবশ্যই পাই। ওর ছবি আমি অ্যাপ্রিসিয়েটও করি। এর বেশি বিচারে আমি যাব না। আমার নিজের বিচার সাবজেকটিভ হয়ে যেতে পারে। সেটা অন্যের ওপরে চাপাতে চাই না।

পত্রিকা: ‘মাছ মিষ্টি মোর’ ছবিতে আপনাকে দেখে মনে হয়েছে আপনি যেন নীললোহিত। বয়স সাতাশ...

সৌমিত্র: তিনশোর ওপর ছবি করেছি। এখন আর এ সব রোল নিয়ে ভাবি না। একটা রোলে কী করে ঠিকঠাক কাজটা করে দেব, ভাবি শুধু সেইটুকুই। তবে হ্যাঁ, সম্প্রতি অতনু ঘোষের ছবি ‘রূপকথা নয়’তে কাজ করে বেশ ভাল লাগল। মনে হয় দর্শকদেরও ভাল লাগবে। চরিত্রটা এক জন অবসরপ্রাপ্ত মানুষের, যার জীবন সম্পর্কে ইন্টারেস্ট আছে। পার্কে যায় নিয়মিত। এবং এই ভাবে সে নানা মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাঁদের পাশে দাঁড়ায়, সাহায্য করে। এই সব নিয়ে একটা ইনট্রিগিং একটা টেল। ভাল লেগেছে অঞ্জন দত্তের ছবি ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’। আগেকার দিনের মতো একটা সহজ সরল গল্প বলার ভঙ্গি। বেশ লেগেছে।

পত্রিকা: ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’তে আপনার নাতি রণদীপ অভিনয় করলেন। ওকে অভিনয় নিয়ে কোনও পরামর্শ দিয়েছিলেন?

সৌমিত্র: না, একফোঁটাও দিইনি। একটা কথা বলি, ওকে শেখানোর দরকার নেই। অভিনয়ের মর্মবস্তু ওর ভেতরে আছে। ওকে যেটা শিখতে হবে তা হল টেকনিক।

পত্রিকা: টেকনিকাল একটা কথা জানতে চাইব। আপনার ডাবিং নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে খুব সুখ্যাতি শুনি। ‘শূন্য অঙ্ক’য় আপনি হুইল চেয়ারে বসে অভিনয় করলেন। ‘হুইলচেয়ার’ সিনেমাটাতেও তাই। দুটো ছবিতেই আপনি এরকম কোনও চেয়ারে না বসেই ডাবিং করেছেন। কিন্তু কণ্ঠে ভাবটা ধরে রেখেছেন এমন ভাবে, যেন হুইল চেয়ারে বসেই কথা বলছেন।... কী করে ব্যাপারগুলো করেন?

সৌমিত্র: ডাবিংয়ের সময়ও তো অভিনয় করতে হয়। ‘আতঙ্ক’য়ে একটা ফলস্ মাড়ি ব্যবহার করেছিলাম। সেটা কিন্তু ডাবিংয়ের সময় ভেবেছিলাম ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু তা করতে হয়নি।
এখন তো আর স্ট্রেট রেকর্ডিং থাকে না ছবিতে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যা থাকত। আমার সুবিধে এইটাই হয়েছিল যে প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’ থেকেই ডাব করতে অভ্যস্ত। তার কারণ সত্যজিৎ প্রচুর পরিমাণে লোকেশন শু্যটিং করতেন। সেই লোকেশনে তো আর সাউন্ড রাখা যেত না। একটা মোটামুটি গাইড ট্র্যাক নিয়ে রাখা হত। ফলে ডাবিংয়ের অনেক প্রয়োজন হত। আমার চোখে ডাবিং অভিনয়ের একটা প্রয়োজনীয় অংশ। অভিনেতা হতে গেলে নিখুঁত ডাবিং জানতেই হবে। আমি উৎপল দত্ত, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়কে খুব ভাল ডাবিং করতে দেখেছি। আবার খুব ভাল অভিনেতা, কিন্তুপুরোনো কালের মানুষ, ডাবিং-এ অভ্যস্ত নন, এও অবশ্য দেখেছি।

পত্রিকা: ‘শূন্য অঙ্ক’র বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরী আপনার কতটা চেনা? যেভাবে আপনি বলেন, ‘অভিযান’-এর নরসিং, কিংবা ‘কোনি’র ক্ষিদ্দা আপনার চেনা...

সৌমিত্র: কবীরের একটা মাত্র অ্যাসপেক্ট অনেক মানুষের মধ্যে দেখেছি। সেটা হল কবীর চৌধুরীর তীব্র ধর্মনিরপেক্ষতা...

পত্রিকা: আজকাল যাঁরা সিনেমার কাজ করছেন, তাঁরা অনেকেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলিং থেকে এসেছেন, অনেকের বাংলা প্রথম ভাষা ছিল না। ইন্ডাস্ট্রিতে কি তবে বাংলা ভাষার গুরুত্বটা কমছে?

সৌমিত্র: বাংলা ভাষা জানতে গেলে যে বাংলা মাধ্যমে পড়তে হবে, তা তো নয়। উৎপল দত্ত কি বাংলা মাধ্যমে পড়েছেন? কিন্তু তাঁর বাংলার জ্ঞান অসাধারণ। তবে এখন শুধু সিনেমা নয়, বেশির ভাগ বাঙালি বাংলা জানে না। অভিনেতার ক্ষেত্রে বাংলা জানাটা খুবই জরুরি। বাংলা সম্পর্কে বোধ না থাকলে সে অভিনয়টা করবে কী করে? উত্তমকুমার তথাকথিত ভাবে বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করেননি, কিন্তু বাংলার চর্চা করতেন, বাংলা বোধ ছিল অসাধারণ। এখন তো বাংলা চর্চাটাই কমে গেছে। খবরের কাগজের বাইরে আর কে কী বাংলা পড়ে আমি জানি না। সেই জন্যই খবরের কাগজের সাঁড়াশি চাপা বাংলায় কথা বলা অভ্যেস হয়ে গেছে বাঙালির। যেমন সিংহভাগ শব্দটা ‘লায়নস শেয়ার’ থেকে এমন আক্ষরিক অনুবাদ, যে ‘ভাগ’ শব্দটা শুনলেই আমার প্রথমেই খুব রাগ হয়।

পত্রিকা: এত দিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন, এত ধরনের চরিত্রে আপনি অভিনয় করলেন। নায়ক থেকে দাপুটে চরিত্রাভিনেতা। কী মনে হয়, উত্তমকুমার যদি বেঁচে থাকতেন তা হলে কি ওই সব চরিত্র দু’জনের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত?

সৌমিত্র: ভাগ হত কি না জানি না। তবে উত্তমদা থাকলে চরিত্রাভিনয়ের দিকে ঝুঁকতেন মনে হয়। তবে নিশ্চিত করে কিছু কেউ বলতে পারে না।

পত্রিকা: কেন বলছেন এ কথা?

সৌমিত্র: একজন অভিনেতা যে বয়স হয়ে গেলে চরিত্রাভিনয়ের দিকে ঝুঁকবেন, এটা স্বাভাবিক। সেইটা যে ওঁর শেষ দিনকার ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে তা নয়। শেষ পর্যন্ত উনি নায়ক চরিত্রেই অভিনয় বেশি করেছেন। তবে অনেক বেশি বয়েস অবধি বাঁচলে উনি তো আর থেমে যেতেন না। নিশ্চয়ই চরিত্রাভিনয়ের দিকেই ঝুঁকতেন। তবে আপনি যে ভাগ হওয়ার কথাটা বলছেন ওটা মানি না। উত্তমকুমারকে ভেবে যে চরিত্র সৃষ্টি, সেটা তাকে দিয়েই হবে। আর যেটা সৌমিত্রকে দিয়ে হবে, সেখানে সৌমিত্রকেই ডাকা হবে। এবং তার পরও একটা কথা আছে। একটা প্রশ্ন তো আছেই, যার ভার্সেট্যালিটি বেশি, সেই অভিনেতার দিকেই কাজ বেশি যাবে। সমান সমান ভাগ হবে, তা তো হয় না।

পত্রিকা: নিজে একজন দর্শক হিসেবে ... উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভার্সেট্যালিটির বিচারে কাকে কতটা নম্বর দেবেন?

সৌমিত্র: আমি তো নিজের বিচার করতে পারি না। নম্বরও দিতে পারি না। সে বিচার করবেন দর্শক। ...তা ছাড়া একটা কথা, উত্তমদা মারা গেছেন ১৯৮০ সালে। এটা ২০১৩। এত বছর পর এই সব নিয়ে ফিরে ফিরে আলোচনা করাটা আমার খুব একঘেয়ে মনে হয়। বড্ড পিছিয়ে পড়া মনে হয়। থেমে যাওয়া মনে হয়। এটা লিখবেন।

পত্রিকা: তবু বলি, আপনি এত বিচিত্র মাধ্যমে কাজ করলেন, হৃদয় উজাড় করে কাজ করলেন, এত বছর ধরে। তবু ‘মহানায়ক’য়ের শিরোপা একজনেরই। ঈর্ষা হয় না? কিংবা দুঃখ...

সৌমিত্র: ঈর্ষা বা দুঃখের কোনও কারণ দেখি না। যে যার মতো কাজের মূল্য পায়। আর উত্তমকুমারের মহানায়কের শিরোপা তো এমনি এমনি নয়। মৃত্যুর এত বছর পরেও মানুষ যাঁকে মহানায়ক হিসেবে মনে রেখেছে, তিনি নিশ্চয়ই মহানায়ক হওয়ারই যোগ্য। তাই হয়েছে।

পত্রিকা: ২০১৩তে ‘সাত পাকে বাঁধা’র পঞ্চাশ বছর হবে। এ ছবিতে সৌমিত্র-সুচিত্রার বিরল অভিনয় আজও মানুষ মনে রেখেছে। এই জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সৌমিত্র-সুচিত্রা আর দুটো মাত্র বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। ‘দত্তা’, ‘প্রণয় পাশা’। আপনাদের দু’জনকে এর বেশি দেখা গেল না। কেন?

সৌমিত্র: বলতে পারব না। আপনাদের একটা ভুল ধারণা আছে ফিল্ম লাইন সম্পর্কে। মনে করেন সব কিছু নায়ক-নায়িকার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। সেটা হয় না। প্রোডিউসর, ডিরেক্টর সব মিলিয়ে একটা অ্যালকেমি। আমি চাইলেই, বা সুচিত্রা সেন চাইলে একসঙ্গে ছবি করা যাবে, তা নয়।

পত্রিকা: সিনেমা আপনাকে তেমন উৎসাহিত করে না। তা হলে কি নাটক উৎসাহিত করে?

সৌমিত্র: হ্যা।ঁ থিয়েটার। কারণ থিয়েটারে আমি আমার কাজগুলো বেশি করতে পারি। যদিও থিয়েটারেও আমি এখন কাজ করার অসুবিধে বোধ করি। কারণ সংগঠনের অভাব। আমার তো কোনও দল নেই।

পত্রিকা: দল করলেন না কেন?

সৌমিত্র: আমি পেশাদার থিয়েটারে কাজ করেছি, তা হলে দল করব কী করে? এখন গ্রুপ থিয়েটারে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি, নিজের দল নেই। এখন যদি দল তৈরি করতে হয়, তা হলে সংগঠনের মাথাটা কে দেবে? আমার তো সেই সময় নেই।

পত্রিকা: এখানে একটা অভিযোগ আপনার সম্পর্কে। আদ্যন্ত থিয়েটার-প্রেমী হয়েও আপনি উত্তর কলকাতার থিয়েটার হলগুলোর দুর্দশার দিনে কোনও ভাবে এগিয়ে এসে কিছু করলেন না ...

সৌমিত্র: না, আমি হল বাঁচানোর উদ্দেশ্যে যাইনি। আমি ভাল থিয়েটার করতে চেয়েছি। যেখানে সুযোগ পেয়েছি সেখানে করেছি। থিয়েটার হল উঠে গেল যখন, তখন আমারও তো পা রাখার জায়গা রইল না।

পত্রিকা: জীবনে কখনও স্ট্রাগল করতে হয়েছে? যেমন স্ট্রাগল আর পাঁচ জন শিল্পীকে শীর্ষে উঠতে গেলে করতে হয়?

সৌমিত্র: মনে করে দেখুন, প্রথম ছবি থেকেই তো আমি সফল। টক অফ দ্য টাউন হয়ে গিয়েছিলাম। সেই জায়গাটাকে ধারাবাহিক ভাবে ধরে রাখার জন্য যা করতে হয়েছে, সেটাকে স্ট্রাগল ছাড়া কী বলব?

পত্রিকা: আজকাল নিজেকে কত বার বলতে হয় ...‘ফাইট, কোনি ফাইট’। শারীরিক অবস্থার জন্য ফাইট করতে হতেই পারে, কিন্তু আর কোনও কারণে কি এখনও লড়তে হয়? এখনও তো দিব্যি সুন্দর কাজ করে চলেছেন।

সৌমিত্র: মানসিক অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। চারপাশটা তো সব সময় সুখের নয়। সেই চারপাশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে গেলে ‘ফাইট, কোনি ফাইট’ এই কথাটা তো বলতেই হয়।

পত্রিকা: শেষ প্রশ্ন, বয়স যত বাড়ে, প্রেম কি তত বাড়ে?

সৌমিত্র: কী প্রেম আমাকে বুঝতে হবে প্রথমে।

পত্রিকা: নরনারীর প্রেম।

সৌমিত্র: না, সে প্রেমে কৌতূহল আমার অনেক দিন হল চলে গেছে।

পত্রিকা: তবু আপনি যে এখনও নারী মনোমোহন পুরুষ সেটা তো জানেন?

সৌমিত্র: জানি হয়তো। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। লোভীর মতো কাঙালপনা করার মানসিকতাও আমার নেই। আমার কৌতূহল এখন মানুষ। মানুষকে এখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। নারীপুরুষ নির্বিশেষে মানুষ যে কত বৈচিত্রময়, তা তো এক জীবনে জেনে শেষ হয় না। একটাই কথা বলতে পারি শেষে, ‘ও হোয়াট এ পিস ওয়ার্ক ইজ ম্যান।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.