|
|
|
|
নিশানায় বুদ্ধ |
নন্দীগ্রাম তদন্তে প্রভাব, অভিযুক্ত রাজ্য |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কাঠগড়ায় তুলতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কে রাজ্য সরকার। সম্প্রতি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় সিবিআইকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছেন, যাঁর নির্দেশে পুলিশ নন্দীগ্রামে গিয়েছিল, সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কেন সিবিআই জেরা করছে না? এর পরেই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন, এ ভাবে কি সিবিআইকে চিঠি লেখা যায়?
রাজ্য প্রশাসনের একাংশই এখন বলছে, যে বয়ানে চিঠি লেখা হয়েছে, তা তদন্তে হস্তক্ষেপেরই নামান্তর। কারণ, খোদ স্বরাষ্ট্রসচিব যখন এমন চিঠি লেখেন, তখন তা তদন্তকারীকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। আর এক দল অফিসার আবার ভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা, স্বরাষ্ট্রসচিব কি চাপের মুখে এই এই চিঠি লিখেছেন?
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে জেরা করার বিষয়টি প্রথমে সামনে আসেনি। রাজ্য সরকার প্রশ্ন তুলেছিল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচ আইপিএসের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ নিয়ে। সিবিআইয়ের চার্জশিটে অভিযুক্ত এই পাঁচ জন পশ্চিমাঞ্চলের তৎকালীন আইজি অরুণ গুপ্ত, মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি এন রমেশবাবু, এসপি অনিল শ্রীনিবাসন এবং দেবাশিস বড়াল ও সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিবিআই মাস ছয়েক আগেই চিঠি দিয়ে সত্যজিতবাবু ও দেবাশিসবাবুর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরুর অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু বাকি তিন আইপিএসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছিল তারা। সিবিআইয়ের এমনতর চার্জশিট পছন্দ হয়নি রাজ্যের। তার পরেই মহাকরণে ডেকে পাঠানো হয় ওই মামলার তদন্তকারী অফিসারদের। রাজ্যের বক্তব্য ছিল, নন্দীগ্রামের গোকুলনগরে যেখানে পুলিশের গুলিতে তিন জনের মৃত্যু হয়েছিল, সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করতে চেয়েছে সিবিআই। অথচ, ভাঙাবেড়িয়ায় যেখানে ১১ জন মারা গিয়েছিলেন, সেখানকার অফিসারদের বিরুদ্ধে কেবল বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। যা প্রথম দু’জনের তুলনায় যথেষ্টই লঘু। সিবিআইয়ের প্রতিনিধিদলের কাছে রাজ্যের প্রশ্ন ছিল, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন? |
|
চিন্তামগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র |
এই সূত্র ধরে তখনই সিবিআইকে সরকার জানিয়েছিল, মামলার নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, যত না প্রশাসনিক কারণে, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক কারণে নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠিয়েছিল বুদ্ধদেববাবুর সরকার। সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশ। এবং তাঁরই নির্দেশে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল মহাকরণ থেকে। তাই রাজ্যের বক্তব্য, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (অর্থাৎ বুদ্ধবাবু)-র নির্দেশ পালন করেছিলেন যে সব অফিসার, কেন শুধু তাঁদেরই বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের চার্জশিট? যিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁর কেন শাস্তি হবে না?
শুধু বাসুদেববাবুর চিঠিই নয়, চার্জশিটে সিবিআইয়ের প্রস্তাবমতো অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিদানের প্রক্রিয়া শুরু না করে যে ভাবে তাঁদের শো-কজ করা হয়েছে, তাতেও অনেকে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। মনে করা হচ্ছে, পাঁচ অফিসারের কাছ থেকে এই কৈফিয়ত তলব শাস্তির প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুত, প্রশাসনের একাংশেরই বক্তব্য, এই ভাবে অফিসারদের শাস্তির বিষয়টিকে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে সরকার সচেতন ভাবেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছে। এর পিছনে একাধিক কারণ দেখতে পাচ্ছেন রাজনীতির কারবারিরা। প্রথমত, বিধানসভা ভোটে হারের হতাশা কাটিয়ে সম্প্রতি বুদ্ধবাবু আবার সরব হয়েছেন। এবং তাঁকে সামনে রেখেই সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছে। এমনকী, নন্দীগ্রাম সংলগ্ন খেজুরিতেও বুদ্ধবাবু সভা করেছেন। সেই সভায় মানুষের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন পঞ্চায়েত ভোটের আগে সিবিআই যদি রাজ্যের কথা শুনে বুদ্ধবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকে, তা হলে সেটা তাঁর পক্ষে তো বটেই, এমনকী সিপিএমের কাছেও বড় ধাক্কা হবে। আর তৃণমূল নতুন অস্ত্র পেয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ছ’মাস আগে সিবিআই যখন চার্জশিট দেয়, তার পরপরই তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন। সেই মামলায় দোষী পুলিশ অফিসারদের শাস্তির পাশাপাশি বুদ্ধবাবু এবং লক্ষ্মণ শেঠের বিরুদ্ধেও যাতে সিবিআই ব্যবস্থা নেয়, সে জন্য আদালতের কাছে আর্জি জানানো হয়।
স্বরাষ্ট্রসচিবের চিঠি প্রসঙ্গে সিপিএম আনুষ্ঠানিক ভাবে এ দিন কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “সিবিআই বা তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে কোনও সরকারি আধিকারিক এ ভাবে চিঠি লিখতে পারেন না! এই ঘটনা সিবিআইকে প্রভাবিত করার নগ্ন প্রচেষ্টা!” তাঁর বক্তব্য “রাজ্য সরকার চাইলে আদালতে হলফনামা দিয়ে বক্তব্য জানাতে পারত। কিন্তু সিবিআই তদন্তের কাজ শেষ করার পরে রাজ্য সরকার কী ভাবে চিঠি লিখে বলতে পারে, এঁকে বা ওঁকে জেরা করুন?”
সিপিএমের বর্ষীয়ান সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেব আচারিয়াও রাজ্য সরকারের উদ্যোগকে ‘সিবিআইকে প্রভাবিত করার চেষ্টা’ বলেই অভিহিত করেছেন। সিপিএম সূত্রে বলা হচ্ছে, নন্দীগ্রামের জন্য যদি বুদ্ধবাবুকে সিবিআইয়ের জেরার মুখে পড়তে হয়, তা হলে লোবা-তেহট্টের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি সিআইডি ডেকে পাঠাবে?
প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতে, “সিবিআই তদন্ত সামগ্রিক ভাবে গোটা ঘটনাটির উপরে হোক। কোনও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে নয়।” তবে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ মনে করেন, সরকার ঠিকই করেছে। তাঁর কথায়, “এত বড় ঘটনা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর অজান্তে বা তাঁর নির্দেশ ছাড়া হয়েছিল, এটা অবিশ্বাস্য!”
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছু বলতে অস্বীকার করেন। মুখ খোলেননি স্বরাষ্ট্রসচিবও। তাঁর বক্তব্য, “বিষয়টি সিবিআইয়ের তদন্তাধীন। তাই কোনও কিছু বলা ঠিক হবে না।”
গুলিচালনা পর্বে বুদ্ধদেববাবু কী ভাবে জড়িত বলে মনে করছে বর্তমান সরকার? স্বরাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র জানান, গুলিচালনার পাঁচ দিন আগে, ২০০৭ সালের ১০ মার্চ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন। নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢোকানোর ব্যাপারে সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়। পর দিন ব্রিগেডে বুদ্ধবাবুও ঘোষণা করেন, নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকবে। ১২ মার্চ বিধানসভায় দক্ষিণ কাঁথির তৎকালীন বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদনে বলেন, ওখানকার ১৭টির মধ্যে ৩টি অঞ্চলে পুলিশ ঢুকতে পারছে না। সরকার জোর করে পুলিশ না ঢুকিয়ে বরং আলোচনা চালিয়ে যাক।
সরকারি নথি বলছে, তার পরের দিনই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩ হাজার পুলিশকর্মী কোলাঘাটে জড়ো হন। সে দিন বিকাল ৪টে নাগাদ ফের শুভেন্দুবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে ফ্যাক্স পাঠিয়ে অপারেশন বন্ধ রাখার অনুরোধ করেন। অপারেশন চললে রক্তগঙ্গা বইবে বলেও আশঙ্কা জানানা হয়। তাতেও সরকার কর্ণপাত করেনি, অভিযোগ শুভেন্দুবাবুর। পুলিশ জানাচ্ছে, অপারেশন শুরু হয় ১৪ মার্চ ভোরে। সেখানেই পুলিশের গুলিতে মারা যান ১৪ জন গ্রামবাসী। সিবিআই তদন্তে নেমে ৭টি বেনামি সিমকার্ডের সন্ধান পেয়েছিল। সেগুলির নম্বর হল ৯৯৩৩৯৪৫১০১ থেকে ১০৭। সেই নম্বরগুলি অপারেশনে থাকা অফিসারেরা ব্যবহার করেছিলেন। সেখান থেকে অপারেশনের আগে-পরে বহু ফোন করা হয়েছিল মহাকরণে। সিবিআই তদন্তে জেনেছে, নন্দীগ্রাম থেকে ফোন এসেছিল মুখ্যমন্ত্রীর ল্যান্ডলাইন নম্বরেও। তাই গুলিচালনার নির্দেশ যে মহাকরণ থেকেই গিয়েছিল, তা মনে করছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের একাধিক কর্তা। রাজ্য প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, তাই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে জেরা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অন্যায় করেনি সরকার। |
|
|
|
|
|