একটি অবান্তর বিষয় লইয়া সরকার এবং সমাজ কী ভাবে অনন্ত সময় নষ্ট করিতে পারে, লোকপাল ও লোকায়ুক্ত তাহার উদাহরণ। সরকারি দুর্নীতি অবশ্যই বড় সমস্যা। প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থার স্বাভাবিক তৎপরতায় সেই দুর্নীতির সন্তোষজনক মোকাবিলা হইতেছে, এমন দাবিও অভিজ্ঞতার ধোপে টিকিবে না। কিন্তু দুর্নীতি দূর করিবার জন্য বিচারব্যবস্থার নিজস্ব কাঠামোর বাহিরে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কেন তৈয়ারি করিতে হইবে, তাহার সদুত্তর নাই। সরকারি কর্মী, আধিকারিক বা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকিলে তাহার বিচার কেন দেশের বিচারবিভাগই করিবে না? তাহার জন্য যদি প্রচলিত আইন বা বিধির সংশোধন আবশ্যক হয়, সংশোধন করিতে হইবে। যদি বিচারবিভাগের পরিকাঠামো, দক্ষতা বা লোকবল বৃদ্ধি আবশ্যক হয়, তাহাও করিতে হইবে। কিন্তু নূতন ‘সমান্তরাল আদালত’ কেন? পুরানো প্রতিষ্ঠানগুলি যে সব বিচ্যুতির শিকার, নূতন প্রতিষ্ঠানও তাহার শিকার হইবে না, এই নিশ্চয়তাই বা কী করিয়া পাওয়া গেল? সত্য ইহাই যে, লোকপাল বা লোকায়ুক্তের পক্ষে সুযুক্তি নাই, আড়ম্বর আছে। আর আছে এ দেশের সমাজ এবং রাজনীতির পরিচালকদের বিচিত্র মানসিকতা যে প্রতিষ্ঠানগুলি আছে সেগুলির সংস্কারের পরিবর্তে নূতন নূতন প্রতিষ্ঠান তৈয়ারির জন্য ব্যস্ত হওয়া। হয়তো ইহাতে মানুষকে এক ধরনের প্রবোধ দেওয়া যায়। রাজনীতিতে প্রবোধের মূল্য বিস্তর।
এই ব্যাধিরই আর একটি দৃষ্টান্ত সি বি আই নিয়োগ লইয়া চলিতে থাকা বিতর্ক। অণ্ণা হজারে হইতে বিরোধী দল সকলেরই অভিযোগ, সরকার সি বি আইকে আপন স্বার্থে ব্যবহার করিতেছে। অভিযোগটি নূতন নয়। অহেতুকও নয়। পুরানো জমানাতেও এই অভিযোগ উঠিয়াছে, এই জমানাতেও তাহা থামে নাই। সি বি আইয়ের মতো একটি সংস্থার অবশ্যই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করা উচিত। কিন্তু তাহার জন্য সি বি আইয়ের কর্তাব্যক্তিদের নিয়োগের পদ্ধতি পালটাইতে হইবে কেন? সরকার নিয়োগ করে বলিয়াই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্তারা সরকারের বা শাসক গোষ্ঠীর ধামাধরা হইবেন ইহা তো কোনও কাজের কথা হইতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন, সেই কারণে তাঁহারা প্রেসিডেন্ট বা তাঁহার দলের বশংবদ হইয়া কাজ করেন, এমন অভিযোগ বিরল। ভারতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ধরনের আনুগত্যের সমস্যা বহুপরিচিত, তাহা এই দেশে আইনের শাসনের সীমাবদ্ধতাই সূচিত করে। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করাই শাসনতন্ত্রের দায়িত্ব। বিশেষত সরকারের, কিন্তু প্রশাসন, রাজনীতি ও সমাজের পরিচালকদেরও। সি বি আই বা অনুরূপ সংস্থার পরিচালকদের নিয়োগ করা সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারি কর্তারা প্রয়োজনে বিরোধী দল-সহ বিভিন্ন মহলের পরামর্শ লইতে পারেন, লওয়া বাঞ্ছনীয়ও বটে, কারণ তাহাতে বহুমতের গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি প্রসারিত হয়। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব সরকারকেই পালন করিতে হইবে। তাহাই গণতন্ত্রের দাবি। |