বাধা দেন তুঘলকি খরচে, সচিবকে তাই চান না গুরুঙ্গ
বিধি-নিয়মের তোয়াক্কা না-করে খেয়াল-খুশিমতো কাজের যে নজির সুবাস ঘিসিঙের জমানায় পাহাড়ে কায়েম হয়েছিল, বিমল গুরুঙ্গের আমলেও তা বহাল রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এবং মহাকরণের কর্তাদের অনেকের দাবি, সেই প্রবণতা রুখতে গিয়েই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন দার্জিলিঙের জেলাশাসক তথা গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রশন (জিটিএ)-এর প্রধান সচিব সৌমিত্র মোহন। সম্প্রতি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে গুরুঙ্গের মুখে প্রধান সচিবকে অপসারণের দাবির পিছনে এই ‘বিরাগের’ই ছায়া দেখছে মহাকরণের সংশ্লিষ্ট মহল।
রাজ্য প্রশাসনের ওই কর্তারা বলছেন, নিছক মহাকরণের অফিসারদের চাপ দিয়ে যে সৌমিত্র মোহনকে সরানো যাবে না, জিটিএ-প্রধান গুরুঙ্গ তা বিলক্ষণ জানেন। তাই নিজের দাবি পেশ করার জন্য দার্জিলিঙের সরকারি অনুষ্ঠানটিকে তিনি বেছে নেন, যেখানে ছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাঁর অফিসারের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে পাহাড়ের উন্নয়ন প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “জিটিএ-র মাধ্যমে যা যা উন্নয়ন করার, আশা করি ওঁরা (গুরুঙ্গেরা) তা বিধি মেনে, ঠিক ভাবে করবেন।”

সৌমিত্র মোহন
সৌমিত্র মোহন স্বয়ং প্রসঙ্গটি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে মোর্চা তাদের দাবিতে অটল। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি এ দিন দিল্লি থেকে বলেন, “ডিএম স্তরের নয়, জিটিএ-র প্রধান সচিব পদে সিনিয়র আইএএস অফিসার চাই। না-হলে আমাদের অসুবিধে হচ্ছে। আশা করি, রাজ্য সরকার এটা বুঝে পদক্ষেপ করবে।”
ঘটনা হল, জিটিএ গঠনের আগে গুরুঙ্গদের সঙ্গে ডিএম সৌমিত্র মোহনের যথেষ্ট ভাল বোঝাপড়া ছিল। জিটিএ নির্বাচনের পরে রাজ্য সরকার জেলাশাসককে তার প্রধান সচিব পদে মনোনীত করে। প্রাথমিক ভাবে আপত্তি করলেও গুরুঙ্গ মেনে নেন। ইতিমধ্যে কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রথম পর্যায়ের ৬৫ কোটি টাকা জিটিএ-র হাতে পৌঁছায়। রাজ্যের তরফে আসে নানা খাতের প্রায় ১০৯ কোটি। ওই সব অর্থ নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট খাতে খরচ করার কথা। কিন্তু অভিযোগ, অতীতে পার্বত্য পরিষদের সময়ে সুবাস ঘিসিং যে ভাবে যথেচ্ছ ব্যয় করতেন, যখন যাঁকে খুশি নিয়োগপত্র দিতেন, জিটিএ-তে তারই পুনরাবৃত্তি শুরু হয়ে যায়। ঘিসিং-জমানার ছবিটা কেমন ছিল?
প্রশাসনিক সূত্রের খবর: ঘিসিং ইচ্ছে হলেই মন্দির গড়তেন। কখনও পাথর পুজোর অনুষ্ঠান করতেন, কখনও বাঁদর পুজো করতেন। যখন, যাঁকে ইচ্ছে চাকরির চিঠি দেওয়াতেন। মর্জিমাফিক বিনা টেন্ডারে কাজ দিয়ে টাকা মঞ্জুরির জন্য অফিসারদের কাছে নোট পাঠাতেন। এ ভাবে দিনের পর দিন সরকারি টাকা অপচয়ের অভিযোগ ঘিসিংয়ের বিরুদ্ধে উঠলেও রাজ্যের তদানীন্তন বাম সরকার বিশেষ কোনও পদক্ষেপ করেনি।
আর এখন অভিযোগ, জিটিএ আমলেও ‘অপচয়ের’ সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে, যার বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রধান সচিব পড়ে গিয়েছেন জিটিএ প্রধানের কোপে। কী রকম?
মহাকরণ-সূত্রের খবর: ২০১১-র জুলাইয়ে জিটিএ গঠনের পরে নির্বাচিত ৪৫ জন সদস্যের প্রত্যেকের জন্য একটা নতুন বড় মাপের বিলাসবহুল গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রধান সচিব তাতে বাধা দেন। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের জন্য দশটি গাড়ি কিনে বাকিগুলো ভাড়ায় নেওয়া হয়। পুজোর মরসুমে নানা সংগঠন ও ক্লাবকে জিটিএ-র তরফে চাঁদা দেওয়া হয়। একাধিক ক্ষেত্রে বিনা টেন্ডারে বরাত দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। উপরন্তু নিয়োগ ও ত্রাণ তহবিলের প্রশ্নে সৌমিত্র মোহনের সঙ্গে গুরুঙ্গের মনোমালিন্য প্রকট হয়ে ওঠে। কী রকম?
প্রশাসনের খবর: গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল (জিএলপি)-এর হাজার পাঁচেক যুবক-যুবতীকে পর্যায়ক্রমে জিটিএ-তে চাকরিদানের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রথম দফায় তিনশো জনকে নিরাপত্তারক্ষী-সহ নানা পদে স্থায়ী ভাবে নিয়োগের সুপারিশ আসে। কিন্তু প্রধান সচিব সুপারিশটি মানতে চাননি। সৌমিত্র মোহনের যুক্তি ছিল, অর্থ দফতরের সম্মতি ছাড়া ওঁদের চাকরি দিলে নিয়োগপত্রে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ভবিষ্যতে তাঁকেই জবাবদিহি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনশো জনকে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে চুক্তি-ভিত্তিক নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। মাসখানেক আগে ২৮ জনের নাম-ঠিকানা পাঠিয়ে তাঁদের চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগপত্র দেওয়ার সুপারিশ পৌঁছেছিল জিটিএ-র প্রধান সচিবের টেবিলে। অর্থ দফতরের সম্মতি ব্যতীত কাউকে চাকরি দেওয়া যায় না এই তথ্য জানিয়ে সৌমিত্র মোহন সেই সুপারিশও পত্রপাঠ মহাকরণে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি জিটিএ প্রধানের ত্রাণ তহবিলে ৫০ লক্ষ টাকা জমা করতে গুরুঙ্গের দেওয়া নির্দেশও কার্যকর হয়নি। এক খাতের টাকা অন্যত্র দেওয়া যাবে না এই যুক্তিতে সৌমিত্র মোহন তা মানতে চাননি।
এ ভাবে বিভিন্ন সময়ে সরকারি বিধি দেখিয়ে প্রধানের সুপারিশ ফিরিয়ে দিয়েছেন সচিব। ফলে দূরত্ব বেড়েছে। এমনকী, গুরুঙ্গ ক’দিন আগে সৌমিত্র মোহনকে ভর্ৎসনাও করেছিলেন বলে মোর্চা-সূত্রের খবর। মহাকরণের কর্তাদের একাংশের দাবি: তাতে কাজ না-হওয়াতেই দার্জিলিঙে উত্তরবঙ্গ উৎসবের মঞ্চে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে প্রধান সচিবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সেখানে অবশ্য গুরুঙ্গের অভিযোগ ছিল অন্য। “উৎসবের খুটিনাটি নিয়ে প্রধান সচিব আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেননি। এটা দুঃখজনক।” বলেছিলেন জিটিএ প্রধান। মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন, “উৎসবের ব্যাপারে যাবতীয় সমন্বয় করেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর। ডিএম তথা প্রধান সচিবের দোষ নেই। এটা বোঝার ভুল হচ্ছে।”
বস্তুত দার্জিলিং পাহাড়ে উন্নয়নের নামে পাঠানো টাকা যাতে বিধিমাফিক খরচ হয়, প্রধান সচিবকে সেটা দেখার দায়িত্ব মহাকরণই সঁপেছে বলে রাজ্যের তরফে বারবার জিটিএ-কে বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের কর্তাদের সে দাবি স্বীকার করে নিচ্ছেন মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতাও। তবে তাঁরা পাল্টা আঙুলও তুলছেন। “খালি আমাদের বার্তা দিলে হবে? রাজ্য সরকারই তো উন্নয়নের টাকায় উৎসব করছে! যথেচ্ছ সংবর্ধনা দিচ্ছে, ক্লাবে-ক্লাবে কোটি কোটি টাকা বিলি করেছে! তা হলে জিটিএ কেন পারবে না?” প্রশ্ন ওঁদের। মোর্চা নেতৃত্ব জিটিএ-তে অনিয়মের অভিযোগও মানতে নারাজ। রোশন গিরির কথায়, “কোনও অনিয়ম কিংবা অনৈতিক সুপারিশ করা হয়নি। আমরা পাহাড়বাসীর কাছে দায়বদ্ধ। সে জন্য যা করা জরুরি, তা-ই করব।” মোর্চা-নেতৃত্বের একাংশ এ-ও বলছেন, “যখন কৈফিয়ৎ দেওয়া দরকার, জিটিএ লিখিত ভাবে দেবে। রাজ্য সরকার প্রতি পদে বাধা দিলে স্বশাসনের মানে কী?”
তবে মোর্চা-তৃণমূল সম্পর্কে যে ‘চিড়’ দেখা দিয়েছে, তা মেরামতির চেষ্টা দু’তরফেই চলছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ফাটল বুজলেও জিটিএ সচিবের পদে সৌমিত্র মোহন কতটা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবেন?
আপাতত এ নিয়েই জল্পনা প্রশাসনিক মহলে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.