|
|
|
|
গৌতমের দৌত্যেই বরফ গলল পাহাড়ে |
কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি |
যতটা গর্জেছেন, এখনই ততটা লড়বেন না কেউই। মঙ্গল এবং বুধবারের যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহের পরে বৃহস্পতিবার সুর অনেকটা নরম করেছে রাজ্য সরকার এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, দু’পক্ষই। তবে প্রত্যেকেরই যে হেতু নিজস্ব রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে, সে হেতু আগামী দিনে পাহাড়ের রাজনীতি নরমে গরমেই চলবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের মত।
বৃহস্পতিবার এ দফার পাহাড় সফর শেষে বাগডোগরা যাওয়ার পথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “পাহাড়ে বড় কিছু হয়নি। কারও উতলা হওয়ার দরকার নেই। এটা মান-অভিমানের ব্যাপার। আগেও অনেক বার হয়েছে। মিটেও যাবে। সব ঠিক থাকলে মাসখানেকের মধ্যেই ফের পাহাড়ে যাব।” মোর্চা নেতারাও ধীরেসুস্থে পা ফেলতে চান। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় তামাং বলেন, “বিষয়টি মিটে গেলেই ভাল। মুখ্যমন্ত্রী মুখে যা বলেছেন, তেমন কাজ করলেই ভাল।” মোর্চা ও তৃণমূলের অন্দরের খবর, মার্চে পাহাড়ে যে পর্যটন উৎসব হতে চলেছে, তাতেই আসতে পারেন মমতা। তবে তিনি মোর্চার অতিথি হিসেবে আসবেন কি না, তা নির্ভর করছে তখনকার পরিস্থিতির উপরে।
কিন্তু আপাতত সন্ধি স্থাপন হল
কী ভাবে? |
শিলিগুড়িতে এনএইচপিসি বাংলোয় মুখ্যমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র |
তৃণমূল সূত্র বলছে বুধবার বিমল গুরুঙ্গের হুমকির পরে আসরে নামেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। মোর্চার শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেন তিনি। গুরুঙ্গের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। মোর্চা নেতাদের গৌতমবাবু বোঝান, পাহাড়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কোনও ইচ্ছা তৃণমূলের নেই। জিটিএ নির্বাচনের সময় তৃণমূল প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েই সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বৃহস্পতিবার আরও স্পষ্ট ভাবে সেই বার্তা দেওয়া হবে। কিন্তু ম্যালের সভায় মুখ্যমন্ত্রীর সামনে গোর্খাল্যান্ডের দাবি ওঠার পরে তাঁর কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ, তা না-হলে পঞ্চায়েত ভোটে
তরাই-ডুয়ার্সে তো বটেই, সমতলেও শাসক দলকে বিপাকে ফেলার সুযোগ পেত বিরোধীরা।
গৌতমবাবু এ দিন বলেন, “আমার কোনও গোপন উদ্দেশ্য নেই। আমি মোর্চা নেতাদের সঙ্গে অবিরত যোগাযোগ রাখছি। কেন না, তা না-হলে পাহাড় শান্ত থাকবে না। পাহাড় নিয়ে যে আমাদের কোনও লোভ নেই, সেটা মোর্চা নেতাদের বুঝিয়েছি। আশা করি ভবিষ্যতে পরিস্থিতি শান্তই থাকবে।”
মোর্চাকে আরও স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার কাজটা হয় এ দিন শিলিগুড়িতে এনএইচপিসি বাংলোয় তৃণমূলের বৈঠকে। মুকুল রায়, গৌতম দেবের সামনে উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ের ২৪ জন নেতা। তাঁদের কয়েক জন বলেন, মোর্চা সূত্রে তাঁরা খবর পেয়েছেন, ম্যালের সভার পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রী সেখানে কড়া ভাষায় ধমক দিয়ে গোর্খাল্যান্ডের স্লোগান থামিয়ে দেওয়ায় বিপাকে পড়েন মোর্চা নেতারা। ওই নেতারা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ফলেই গুরুঙ্গকে চড়া সুরে মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করতে হয়েছে।
তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, গুরুঙ্গের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে দল কড়া অবস্থান নেবে, এমন আশা নিয়ে বৈঠকে এসেছিলেন পাহাড়ের অনেক নেতা। কিন্তু তাঁদের স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়, মোর্চা অসন্তুষ্ট হয় এমন কিছু করা যাবে না। মোর্চা নেতারা গৌতমবাবুর কাছে অভিযোগ করেছিলেন, পাহাড়ের তৃণমূল নেতাদের কাজেকর্মে জিএনএলএফ বা গোর্খা লিগ উৎসাহিত হচ্ছে। সেই অভিযোগের সুরাহা করার আশ্বাসও মোর্চা নেতাদের দিয়েছিলেন গৌতমবাবু। বৈঠকে পাহাড়ের নেতাদের এ ব্যাপারেও স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ দিন মাঝ পথেই বৈঠক ছেড়ে চলে যান কালিম্পংয়ের ছয় নেতা। তাঁদের তরফে সং ভুটিয়া ও উর্গেন শেরপা বলেন, “আমরা যে রকম চেয়েছিলাম, বৈঠকে তেমনটা কথা হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীও আমাদের সময় দিলেন না। তাই আমরা চলে যাচ্ছি।” তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, মোর্চার সঙ্গে সন্ধি করে আখেরে তাঁদের সুবিধাই হবে। |
শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
এক দিকে, মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে গিয়ে যে কড়া ভাষায় কথা বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোটে সে কথা প্রচার করা যাবে। অন্য দিকে, গুরুঙ্গকে আলোচনার টেবিলে এনে ফের পাহাড়ের পর্যটন মরসুমকে জমজমাট করতে পারলে মুখ্যমন্ত্রী ‘পাহাড় হাসছে’ বলে ফের প্রচার করতে পারবেন। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “সামনে পাহাড়ে পর্যটন মরসুম। সমতলে পঞ্চায়েত ভোট। সব দিক খেয়াল রেখেই দলনেত্রী পদক্ষেপ করছেন। বিরোধীরা যা-ই বলুন না কেন, মুখ্যমন্ত্রী সব সামলে নেবেন।”
বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও একই কথা বলেছেন। এ দিন শিলিগুড়িতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “পাহাড়কে কেউ জোর করে কাঁদাতে পারবেন না। পাহাড়ের হাসি ধরে রাখবই, এটা আমার চ্যালেঞ্জ।” তাঁর বক্তব্য, “আমরা কমিটমেন্ট ছাড়া কিছু করিনি। জিটিএ হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে। পাহাড়ের সর্বত্র উন্নয়ন হচ্ছে। পর্যটন অনেক ভাল জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। এই অবস্থায় অশান্তি হলে পাহাড়ে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সকলেই গণতান্ত্রিক পথে চলার শপথ নিয়েছি। রক্তক্ষয়ী আন্দোলন গণতন্ত্র-বিরোধী। মোর্চা সে পথে হাঁটবে না বলেই আশা করছি।” সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, “কোথাও অশান্তি হতে দেব না। শুধু দার্জিলিং নয়, জঙ্গলমহল, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর-সহ রাজ্যের কোথাও অশান্তি হতে দেব না।”
ম্যালের সভায় নিজেকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ কেন বলেছেন তা নিয়ে মমতার সাফাই, ‘‘সরকারের একটি মানবিক মুখ থাকে। আর একটা থাকে অনুশাসন। তা ছাড়া কিছু চলতে পারে না। এই কারণেই ওই কথা বলেছি।”
সরকার তথা তৃণমূলের এই ব্যাখ্যায় আপাতত সন্তুষ্ট মোর্চা। এ দিনই দার্জিলিঙের পাতলেবাসে মোর্চা নেতাদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা এবং তৃণমূলের বার্তা নিয়ে আলোচনা হয়। তার পরেই সিদ্ধান্ত হয় সুর নামানোর।
মোর্চা নেতা বিনয় তামাং বলেন, “আমরা বুঝি, পাহাড় নিয়ে তৃণমূলের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আমাদের দাবিয়ে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করলে কী হবে, তা ওঁরা বুঝেছেন। আশা করি তার পুনরাবৃত্তি মুখ্যমন্ত্রী করবেন না। অনেক ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর কথায়-কাজে মিল থাকছে না। গোর্খাল্যান্ডের দাবি আদায় যে আমাদের অন্যতম স্বপ্ন ও স্লোগান, সেটা মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝতে হবে। হুটহাট রেগে গেলে চলবে না।” প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যও জিটিএ-কে দাবিয়ে রেখে পাহাড়ে শান্তি ফেরানো যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথায়, “পাহাড়ের মানুষের স্বশাসন নিয়ে আবেগ রয়েছে। স্বশাসন দেওয়ার পরে কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা ঠিক নয়।” |
|
|
|
|
|