উত্তরবঙ্গের পাহাড়-জঙ্গল-চা বাগান রয়েছে, পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা-শঙ্করপুর-মন্দারমণি রয়েছে, আছে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মন্দির। অথচ পর্যটন-ক্যালেন্ডারে ঠাঁই নেই পশ্চিম মেদিনীপুরের।
সম্প্রতি জঙ্গলমহলের এই জেলায় পর্যটনকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রায় সাত কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তারই মধ্যে পর্যটন দফতরের তৈরি করা ক্যালেন্ডার থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর বাদ পড়ে যাওয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছে। পাহাড়-সমুদ্রের জেলাগুলি ছাড়াও কলকাতা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদের মতো অনেক জেলারই দ্রষ্টব্য স্থানের ছবি ছাপা হয়েছে এই ক্যালেন্ডারে। সেখানে জেলার একটিও ছবি না থাকায় বিস্মিত সিপিএম পরিচালিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এটা ভাবতেই অবাক লাগছে যে, পর্যটন দফতরের ক্যালেন্ডারে আমাদের জেলা স্থান পেল না। অথচ, পর্যটনের দিক দিয়ে এই জেলার গুরুত্ব যে কী অপরিসীম তা সাধারণ মানুষও জানেন।”
এর পিছনে কোনও কারণ আছে বলে অবশ্য মানতে চাননি পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। তাঁর ব্যাখ্যা, “ক্যালেন্ডারের জন্য পর্যটনস্থল বাছাই করা হয়েছে। ১৯টি জেলার সবকটির প্রতিনিধিত্ব রাখতে গেলে তো মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হত।”
জঙ্গলমহলের এই জেলায় ছোটখাট বেড়ানোর জায়গা রয়েছে অনেকই। নিসর্গ সৌন্দর্যে ঘেরা বেলপাহাড়ি থেকে দাঁতনের মোগলমারিতে প্রত্নস্থল, কিংবা মন্দিরঘেরা পাথরা ভ্রমণপিপাসু লোকজন বারবার ভিড় জমিয়েছেন এখানে। বেলপাহাড়ির কাঁকড়াঝোর, গাড়রাসিনি পাহাড়, ঘাঘরা, লালজল কিংবা গোপীবল্লভপুরের হাতিবাড়িতে একটা সময় নিত্য যাতায়াত ছিল সাধারণ নাগরিক থেকে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের। জামবনির চিল্কিগড়ে কনকদুর্গার মন্দিরেও ভিড় জমাতেন অনেকে। মাঝে কয়েকটা বছর মাওবাদী সক্রিয়তার জন্য ছন্দপতন হয়। পর্যটকেরা জঙ্গলমহল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।
এখন ছবিটা পাল্টেছে। জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরেছে। ফিরেছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। তাই ফের চাঙ্গা হতে শুরু করেছে ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, লালগড়ের পর্যটন ব্যবসা। ঝাড়গ্রাম সাব ডিভিশনাল লজ-হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন কর্মকার বলেন, “শীতের মরসুমে তো এ বার সব আগাম হোটেল বুকিং হয়েছে।” ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে অবস্থিত রাজ্য পর্যটন দফতর অনুমোদিত ‘দি প্যালেস ট্যুরিস্ট রিসোর্ট’-এর ম্যানেজার অশ্রুকুমার মাইতিরও বক্তব্য, “বিগত তিন বছরের মন্দা কাটিয়ে গত কয়েক মাস ধরে ভাল বুকিং হচ্ছে। ছুটি কাটাতে আসা মানুষজনের সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে।”
জঙ্গলমহলের বাইরেও বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে জেলায়। যেমন, মেদিনীপুর শহরে ইকো ট্যুরিজম পার্ক, সদর ব্লকের প্রাচীন মন্দির ঘেরা পাথরা। রয়েছে রানি শিরোমণির স্মৃতি বিজড়িত কর্ণগড়। গড়বেতার গনগনি, আড়াবাড়ির জঙ্গল, পরিমল কানন কিংবা দাঁতনের শরশঙ্কাতেও বেরাতে আসেন অনেকে। মনীষী-স্মৃতির টানে বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান বীরসিংহ, ক্ষুদিরামের মোহবনিতে ভিড় জমান আগ্রহীরা। এই সব এলাকায় কোনওদিন মাওবাদী সক্রিয়তাও ছিল না। ফলে, উৎসকুদের আনাগোনা কমেনি। তাই জেলার মানুষই প্রশ্ন তুলছেন, সরকার যেখানে একদিকে এই জেলাকে পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনতে চাইছে, কখন কেন জেলার একটি এলাকাও স্থান পেল না পর্যটন-ক্যালেন্ডারে? সদুত্তর কিন্তু মেলেনি। |