পাহাড়ে আগুন জ্বালানোর হুমকি
বিভাজন করছেন মমতা, অভিযোগ গুরুঙ্গের
খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক।
মঙ্গলবার দার্জিলিঙে ম্যালের সভায় গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে স্লোগান শুনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, “মনে রাখবেন আমি কিন্তু রাফ অ্যান্ড টাফ।” ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিজনবাড়িতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের কথায় বোঝা গেল, ওই দাবিতে তাঁরাও সমান কঠিন ও কঠোর। মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের উল্লেখ করেই গুরুঙ্গ বুধবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “এমন ভাষা ব্যবহার ঠিক নয়। সকলে জেনে রাখুন, গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে প্রয়োজনে বন্দুকও ধরব। গুলি খেতেও রাজি। আগামী দিনের আন্দোলনে সেটা স্পষ্ট করে দেওয়া হবে। পাহাড়ে আগুন জ্বলবে।
খুন-খারাপি হবে। গোর্খাল্যান্ড না-দিলে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। দরকার হলে জিটিএ-ও ছেড়ে দেব।” তার পরেই কারও নাম না-করে মোর্চা সভাপতির বক্তব্য, “উন্নয়নের নাম করে বিভাজন ও শান্তিভঙ্গের চেষ্টা করলে আগামী দিনে কাউকে পাহাড়বাসী ঢুকতে দেবেন না।”
সৌজন্য। লাভার একটি বৌদ্ধগুম্ফায়।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বুধবার সারা দিন পাহাড়েই ছিলেন। তবে দার্জিলিং সদর থেকে অনেক দূরে, প্রত্যন্ত আলগাড়ায়। সেখান থেকে লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ যান। সেখানে তিনি লেপচাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ নিয়ে আলোচনা করাতেও পাহাড়ে ‘বিভাজনের গন্ধ’ পেয়েছেন গুরুঙ্গ। তাঁর বক্তব্য, “যদি পাহাড়ের উন্নয়নই মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষ্য হয়, তা হলে তো জিটিএ-র সঙ্গে বৈঠক করা উচিত ছিল। দার্জিলিঙেই থাকতে পারতেন। তা না-করে কালিম্পঙে চলে গেলেন কেন? এতেই তো ওঁর নানা উদ্দেশ্য রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে। উনি চাইলেও আলাদা লেপচা উন্নয়ন বোর্ড হতে দেব না।”
এ দিন দিল্লিতে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরিও বলেন, “ওই উন্নয়ন পর্ষদ যে আমরা করতে দেব না, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে বিভাজন তৈরি করতে চাইছেন।” তবে গুরুঙ্গ যে জিটিএ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, সেই প্রসঙ্গে রোশন বলেন, “জিটিএ থেকে পদত্যাগ করব কি না, তা সময়ই বলবে।” গুরুঙ্গ জানিয়ে দিয়েছেন, “আগামী ১০ মার্চ শিলিগুড়ির কাছে সুকনায় ২ লক্ষ মানুষের জমায়েত থেকে শুরু হবে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে দ্বিতীয় লড়াই।”
ম্যালের ওই সভা থেকেই যে সম্পর্কে চিড় ধরা শুরু হয়েছে, তা-ও এ দিন গুরুঙ্গের কথায় স্পষ্ট।
গুরুঙ্গ মনে করছেন, তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে তৃণমূল। তিনি বলেন, “ম্যালের সভামঞ্চ থেকে গোর্খাল্যান্ড-বিরোধী কোনও বক্তব্য রাখা হবে না বলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব আশ্বাস দেন। সে জন্য প্রথমে অরাজি হলেও পরে সেখানে যাই। কিন্তু সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মোর্চার নেতা-কর্মীরা খেপে গিয়ে স্লোগান দেন। তা থামাতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা পাহাড়বাসী মেনে নিতে পারেননি।” গৌতমবাবু অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গুম্ফায় দর্শনে মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার লাভায়।
গুরুঙ্গের এই নজিরবিহীন আক্রমণের মুখে মমতা প্রতিক্রিয়া জানাননি। বরং নিজস্ব ঢঙে কালিম্পঙে একাধিক নতুন জায়গা ‘আবিষ্কার’ করে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তবে দলীয় সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী যথেষ্ট বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন। দলের নেতাদের প্রতিও তিনি বিরক্ত হয়েছেন। বিজনবাড়ির সেতুটি ম্যাল থেকে উদ্বোধন করলে গুরুঙ্গ যে ক্ষিপ্ত হতে পারেন, সেটা দল কেন আগে থেকে আঁচ করতে পরেনি, সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন বিরক্ত মমতা। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রশাসনিক ভাবে মোর্চার ক্ষোভ সামলানোর পন্থা ভাবার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, পাহাড়ে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাও আরও বাড়াতে। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে এনএইচপিসি বাংলোয় পাহাড়ের তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বৈঠক করতে পারেন তিনি। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মোর্চার অনেক কথাই মেনে নিয়েছেন। যেমন গুরুঙ্গের আর্জি মেনে এক কথায় তাঁর পদটিকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমমর্যাদা সম্পন্ন করে দিয়েছেন। অতীতে অনেক বার ভুল বোঝাবুঝি আলোচনার মাধ্যমে মেটানো হয়েছে। কিন্তু এ বার কেন এমন হল, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।”
পাহাড়-সমস্যা ফের জটিল হতে শুরু করায় সর্বদল বৈঠক ডাকার দাবি তুলেছে বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “সমস্যা হল, মুখ্যমন্ত্রীর যখন শক্ত হওয়া দরকার তখন তিনি নরম এবং যখন নরম হওয়ার দরকার, তখন শক্ত!” দার্জিলিঙের সিপিএম নেতারা মনে করেন, তড়িঘড়ি সমস্যার সমাধানের কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টাতেই জটিলতা বাড়ছে। সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের কথায়, “পাহাড়ে স্বশাসন দেওয়ার পরে সেখানে কোনও সরকারি অনুষ্ঠান করতে গেলে সেখানকার জনপ্রতিনিধিদের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হবে। মনে হয় তাড়াহুড়ো করে সব কাজ করতে গিয়ে সরকার সমস্যায় পড়েছে।” রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছে কংগ্রেসও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, “দার্জিলিং কোনও একটা দল বা সরকারের সমস্যা নয়। গোটা বাংলার সমস্যা। সে জন্যই ওটা নিয়ে সর্বদল বৈঠক করা উচিত ছিল।”
গোর্খা লিগ, জিএনএলএফ, সিপিআরএম-এর একাধিক প্রথম সারির নেতা কিন্তু সন্দেহ করছেন যে, পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে মোর্চা-তৃণমূল ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ ভাব দেখাচ্ছে। সিপিআরএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অরুণ ঘাটানির অভিযোগ, “শীঘ্রই জিটিএ সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার কথা। তখন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোট হবে। তাই গোর্খাল্যান্ডের বিষয়টিকে সামনে রেখে ঘর গোছাচ্ছে মোর্চা। পক্ষান্তরে, রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে তরাই, ডুয়ার্স-সহ সমতলে বাংলা ভাগের বিরোধিতার বিষয়টিকে সামনে রেখে বাড়তি সুবিধা নিতে সক্রিয় তৃণমূল।” ঘটনা হল, মোর্চার সঙ্গে সংস্রব ছিন্ন করলে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সমর্থন পেতে পারে তৃণমূল। পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকে বলেছেন, “তৃণমূল মোর্চার সংস্রব ছাড়লে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।”
যদিও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, একেই রাজ্যে শিল্প আসছে না। নানা সমালোচনায় জেরবার রাজ্য। এই অবস্থায়, পাহাড় ও জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দাবি ঘিরে তাঁর মুকুটে যে দু’টি পালক উঠেছে, তা মাত্র কয়েকটি পঞ্চায়েত আসনের জন্য তৃণমূল নেত্রী নষ্ট হতে দেবেন না। তবে পাহাড়ে এখনকার পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দার্জিলিং ও সিকিমের পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত সকলেই। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্যুর অপারেটরসের সিকিম ও নর্থ বেঙ্গলের চেয়ারম্যান সুরেশ পেরিয়াল বলেন, “সব তো ঠিকই ছিল। হঠাৎ এমন কী হল বুঝতে পারছি না। গত দু’বছর ধরে পর্যটন ক্ষেত্রে দারুণ ব্যবসা হচ্ছে। আমরা সব পক্ষের কাছে পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। না হলে সকলেরই ক্ষতি।”
সম্ভবত পরিস্থিতির এই পরিবর্তন টের পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীও। আগের মতো পাহাড়ে আর এ বার গাড়ি থেকে হঠাৎ নেমে পড়েননি। কার্যত বাম আমলের মতোই নিরাপত্তার লৌহজালই যেন বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর চারপাশে। কনভয়ের গাড়ির সংখ্যা অন্তত ১০টি বাড়িয়ে ৩৫ করা হয়েছে।

বুধবার সন্দীপ পালের ছবি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.