প্রবন্ধ ২...
টাকা রাখার আগে খোঁজখবর করা ভাল
র্থ লগ্নির বাজারে আকস্মিক সঙ্কট এখন দুনিয়া জুড়েই খুব পরিচিত ব্যাপার। ১৯৯৭ সালে এশিয়াতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, আমাদের দেশে তার বিশেষ আঁচ লাগেনি। ২০০৮ সালে মার্কিন মুলুকে এবং তার পরে ইউরোপে অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাবে পৃথিবী আরও অনেক দিন ভুগবে। ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজার, নানা ধরনের আমানত সংগ্রাহক সংস্থা, আর্থিক পুঁজির ক্ষিপ্র গতিতে নানা দেশের বাজারে আগমন ও নিষ্ক্রমণ, এক বাজারের অনিয়ন্ত্রিত ওঠানামার প্রতিক্রিয়ায় অন্য বাজারে অস্থিরতা ইত্যাদি নানা কারণ এই ধরনের বিপর্যয় বা সঙ্কটের জন্ম দেয়, তাকে লালন করে। কিন্তু এই সঙ্কট সৃষ্টিকারী উপাদানগুলির মধ্যে একটি মৌলিক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যাঁরা বিনিয়োগ করছেন, বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা, বিনিয়োগের গতিবিধি এবং গন্তব্যস্থল সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের চরম অনীহা। যত দিন আমানত থেকে ঠিক ঠিক আয় ঘরে আসে, তত দিন আমরা জানতেও চাই না, আমাদের টাকা কোথায় কী ভাবে খাটানো হচ্ছে। তার পর এক দিন হঠাৎ শোনা যায়, আমানত ঠিক মতো বিনিয়োগ হয়নি, কিংবা এমন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে যা আইনসম্মত নয়, তাই আমানতসংগ্রহকারী জেলে যাচ্ছে কিংবা ফেরার হয়েছে। তখন আর কিছু করার থাকে না।
পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের নানা রাজ্যে এমন অনেক সংস্থা কাজ করছে যারা সাধারণ মানুষের কাছে ছোট ছোট আমানত সংগ্রহ করে খাটায় ও সুদ সহ সেই টাকা ফেরত দেয়। স্বভাবতই সুপরিচিত ‘চিট ফান্ড’ বা সে ধরনের আমানত ব্যবসার কথাও এই প্রসঙ্গে চলে আসে। এ ধরনের সংস্থাগুলি আইনানুগ ভাবে আমানত সংগ্রহ করছে কি না, সেটা দেখবেন নিয়ন্ত্রণকারীরা। আইনের সঙ্গে এই আমানত সংগ্রাহকদের কোনও সংঘাত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে মন্তব্য করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমরা শুধু দেখতে চাইব, এই ধরনের ব্যবসার পিছনে কোন অর্থনীতি কাজ করে।
ধরা যাক, আমি আপনার কাছে একশো টাকা আমানত নিয়ে বললাম, আপনাকে এক বছর বাদে কুড়ি টাকা সুদ দেব। ব্যাঙ্কের সুদের চেয়ে এটা দ্বিগুণেরও বেশি। আমি টাকাটা কোনও বিনিয়োগ করলাম না, শুধু বছরের শেষে আরও দু’জনের কাছে দুশো টাকা জোগাড় করে আপনাকে একশো কুড়ি টাকা ফেরত দিলাম। আপনি আপ্লুত হয়ে আমাকে পাঁচশো টাকা দিলেন। তা দিয়ে ওই দু’জনের টাকাটা আমি মিটিয়ে দিলাম।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ করুন। এই গোটা প্রক্রিয়ায় আমি ওই আমানতকারীদের টাকা ঠিক ঠিক মিটিয়ে দিয়ে আস্থা অর্জন করলাম, আবার সেই বিশ্বাসকে মূলধন করে আরও আমানত জোগাড় করে এক জনের টাকায় আর এক জনকে খুশি করলাম। কালক্রমে আমার প্রতি বিশ্বাসের স্তম্ভ আরও মজবুত হল। এর টাকা ওকে দেওয়ার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল। একটি টাকাও কোথাও বিনিয়োগ করতে হল না, কোনও সম্পদ সৃষ্টি করতে হল না।
যদি এমন ‘ব্যবসা’ চলতে দেওয়া হয়, নিয়ন্ত্রণের জন্য আবশ্যক জোরদার আইন না থাকে, নিয়ন্ত্রকরা চোখ-কান-খোলা, নিরপেক্ষ, সৎ, বুদ্ধিমান না হন, তা হলে একশো টাকার আমানত তুলে তা থেকে মাত্র দশ টাকা লোক-দেখানো বা লোক-ঠকানো বিনিয়োগ করলেও কিছু যায় আসে না। আসল কথা হল, যথেষ্ট পরিমাণে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না। এ রকমও হতে পারে, কোনও কোম্পানি প্রথম দিকে অসৎ ভাবে আমানত সংগ্রহ করে চড়া সুদ দেওয়ার ব্যবস্থা ভাল ভাবে চালিয়ে পরে তার থেকে কিছু টাকা আইনানুগ পথে সফল ভাবে বিনিয়োগ করল। আসলে কোনও ভাবে লোকের আস্থা অর্জন করে যদি আমানতের ধারা বহমান রাখতে পারা যায়, তা হলে কালে কালে এই সব কোম্পানির এত নামডাক হবে, এত লোক আমানত সংগ্রহ বাবদ প্রাপ্ত কমিশনের টাকায় জীবিকানির্বাহ করবে, এত মানুষের আর্থিক ভবিষ্যৎ এর উপর নির্ভর করবে, যে তখন সরকার এদের বিরুদ্ধে যে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার আগে দু’বার ভাববেন। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, যথাযথ বিনিয়োগ ছাড়া সুদ দেওয়ার কারবার ভয়ঙ্কর এক ঝুঁকির অবস্থা তৈরি করে।
একশো টাকার আমানত সংগ্রহ করে যদি ঠিকঠাক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে কুড়ি শতাংশ সুদ দিতে হয়, তা হলে সেই প্রকল্প থেকে অন্তত বাইশ থেকে পঁচিশ শতাংশ হারে রোজগার হতে হবে, না হলে আমানত সংগ্রহকারী ব্যবসা করবেন কেন? কোনও উৎপাদনশীল প্রকল্পে এমন রোজগারের হার দূর অস্ত্। শেয়ার বাজারে টাকা খাটালে কিছু কিছু সময় এমন রোজগার সম্ভব, কিন্তু প্রথমত সেই হার বেশি দিন ধরে রাখা যায় না এবং দ্বিতীয়ত, শেয়ার বাজারের আয় স্বভাবতই ঝুঁকিপূর্ণ।
সুতরাং আমানতকারীর টাকা সংগ্রাহকরা ঠিক কী ভাবে, কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করছেন, সেটা বিশেষ ভাবে জানা প্রয়োজন। সেটাই নিয়ন্ত্রকের কাজ। গল্প নয়, লিখিত নথিপত্রও যথেষ্ট নয়, চাক্ষুষ যাচাই করে দেখা প্রয়োজন। সে জন্য দরকার, যাকে বলা হয়, ‘র‌্যান্ডম অডিট’, অর্থাৎ কিছু কিছু আমানতকারীকে যথাযথ উপায়ে বেছে নিয়ে আগে থেকে না জানিয়ে হঠাৎ হঠাৎ তাদের কারবার সম্পর্কে যথাযথ খোঁজখবর করা। সমস্যা হল, আমানতকারীদের কাছে যদি ঠিক সময়ে আমানত বাবদ চড়া হারে সুদ চলে আসে, তা হলে কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করতে তাঁদের উৎসাহ থাকবে না। এক অর্থে প্রচুর ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারলেই কেল্লা ফতে। আর এই বিশ্বাসজাত ক্ষমতা ধীরে ধীরে নিয়ামক নিয়ন্ত্রকদের আচ্ছন্ন করবে এ দেশে এমনটাই তো হয়ে থাকে।
যারা অন্যায় কারবার চালায়, তাদের শুভবুদ্ধির ভরসা করে কোনও লাভ নেই। আমাদের দেশে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপরেও যথেষ্ট আস্থা রাখা কঠিন, কারণ সব কিছুই সাধারণত খুব ঢিলেঢালা। তাই, মোদ্দা কথা হল, সাধারণ মানুষকেই সতর্ক থাকতে হবে। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির চূড়া পর্যটকদের মুগ্ধ করতে পারে, কিন্তু এক বার বিস্ফোরণ শুরু হলে কিছু করার থাকে না।

কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.