প্রবন্ধ ১...
যদি মূর্খ থাকতে চাও, বইমেলায় যাও
মরা নিজেদের কতটা জানি, কতটা বুঝতে পারি? মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়, গোটা বাঙালি জাতির মানসিক কাঠামো এমন যে মাদক ছাড়া তার বাঁচা অসম্ভব। পুজো-পার্বণগুলিতে তদ্গত দেবদেবী বা ঋতুবন্দনার মধ্য দিয়ে আত্মনিবেদন যতটুকু, তা ছাপিয়ে উত্তেজনার উৎস অন্বেষণ। আদি অভিপ্রেতগুলি ধুয়েমুছে গিয়েছে, এখন শুধু একটি মাতোয়ারার ঝাঁপি থেকে ক্রমান্বয়ে অন্য অন্য উন্মত্ততার ভিড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বছরটিকে কাটিয়ে দেওয়া। দৈনন্দিন জীবনযাপন হয় বড় কঠিন, নয় অতি সাদামাঠা, উত্তেজনার প্লাবনের পর প্লাবন তা ভুলিয়ে দেয়, অন্তত ভুলিয়ে দেবে সেই ভরসায় বাঙালি পুজো-পার্বণ আঁকড়ে থাকে। একটা সময় আসে যখন প্রাচীন ও প্রচলিত পুজো-পার্বণগুলি থেকে আর তেমন ‘তার’ পাওয়া যায় না, নতুন কোনও মাদকবস্তুর জন্য বাঙালিকে তাই আকুলিবিকুলি শুরু করতে হয়। আংশিক বা পরিপূর্ণ সফলতাও মেলে, যেমন হয়েছে বইমেলার ক্ষেত্রে। বাঙালির ঈষৎ নাক-উঁচু গর্বের সঙ্গে উত্তেজনার নিটোল মিশেল, যা ঘটেছে গত চার-পাঁচ দশকের রুদ্ধশ্বাসে পেরিয়ে আসা বছরগুলিতে।
গত শতকের সত্তরের দশকে বইমেলা একটি মোলায়েম, সীমিত পরিমাপের প্রচার-অনুষঙ্গ হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিল, সম্ভবত বিদেশি অনুপ্রেরণাও কিছুটা কাজ করেছিল। অস্বীকার করে লাভ নেই, প্রাথমিক স্তরে উৎসাহের প্রধান জোগানদার ছিলেন প্রকাশক সম্প্রদায়, এখনও তাঁরাই কলকাতাস্থ কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের হাল ধরে আছেন। কিন্তু একটু একটু করে গোটা ব্যাপারটি আদি উদ্যোক্তাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক সামাজিক অনুভবে পরিণত হল, আত্মশক্তিই যার চালক। প্রকাশকদের প্রাথমিক পৌরোহিত্যের পালা চুকতে না চুকতেই রাজ্য প্রশাসন এ দিক পানে ঝুঁকল। তার পর হাওয়ায় হাওয়ায় কী যে মাদকতা, পাড়ায় পাড়ায় দাদাদিদিরা এগিয়ে এলেন, তাঁদের গত তো বাঁধাই ছিল, সুরও তৈরি, এমন একটি অভিনব উপলক্ষ, আমরা মিলেছি আজ মেলার ডাকে। পরবর্তী পর্যায়ে বইমেলার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু, কলকাতা বইমেলাকে আগলে রাখতে পারল না, প্রতিটি জেলা শহরে, ক্রমে আধো-গ্রাম-আধো-শহর গোছের অঞ্চলে, তার পর গহনতম গ্রামে তা দীপ্তশিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। বাঙালি জাতি একটি নতুন পার্বণ আবিষ্কার করল: আমাদের তল্লাটে একটা বইমেলার ব্যবস্থা না করতে পারলে মুখ দেখাব কী করে!
বিদ্যানুরাগী। ‘বইমেলা’। কলকাতা ২০১২। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
যে কোনও পার্বণ একটি সামাজিক বাস্তব হয়ে উঠলে তার জন্মবৃত্তান্তের উৎস নিয়ে বিস্তৃত হওয়া যায়, সমাজবিজ্ঞানীরা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখে নানা ধরনের বিশ্লেষণ পেশ করতে পারেন। কেউ কেউ বাঁকা চোখে পার্বণটির মুণ্ডপাতও করতে পারেন। তবে ইতিমধ্যে সেই পার্বণ এর-ওর-তার নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। কী ভাবে বাঙালি বইমেলা এখন থেকে বিবর্তিত হবে, কারও পক্ষেই আর স্পষ্ট প্রত্যয়ে বলা সহজ নয়। বইমেলার ভবিষ্যৎ ইতিহাস এখন থেকে বাঙালির সামগ্রিক সামাজিক প্রক্রিয়া-বিক্রিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য, বাঙালি সমাজ যে-রকম চাইবে বইমেলাও সে-রকম আদল নেবে।
স্ব-ঘোষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী গর্ব করে দাবি করতে পারেন, এই পার্বণটির উৎসে কোনও ধর্মীয় নামগন্ধ নেই। বাঙালি মানসের একটি বিশেষ ঝোঁক বুদ্ধির চর্চা। বাঙালিদের ধারণা যার কোনও দোসর পৃথিবীর অন্য কোথাও মিলবে না। সেই বুদ্ধির চর্চাই নাকি বইমেলাকে লালন করেছে, পালন করে যাবে। কূপমণ্ডূক আস্ফালন, হয়তো শূন্যকুম্ভের আস্ফালন।
এই পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে মেনে নেওয়া যায়। বাঙালি পার্বণ ছাড়া বাঁচতে পারে না। সে একটি নতুন পার্বণের জন্ম দিয়েছে, কৃতিত্বটুকু তার প্রাপ্য। অথচ মুশকিলটা তো সেখানেই, সব পার্বণই তো শেষ পর্যন্ত হুজুগে গিয়ে দাঁড়ায়। বইমেলাই বা সেই ললাটলিখন এড়াতে পেরেছে কি? প্রকাশক সম্প্রদায় খুব বেশি দূর ভাবতে শেখেননি, যতটুকু পেয়েছেন, তা-ই তাঁদের আশাতীত। গোটা প্রাঙ্গণ জুড়ে কর্তালি করবার অধিকার হারানোর দুঃখ তাঁরা পুষে রাখেননি। গন্ধ শুঁকে বৃহৎ পুঁজির মালিকরাও এখন বইমেলার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত: এক সঙ্গে এত সচ্ছল-সঙ্গতিসম্পন্ন মানুষ বইমেলায় জড়ো হচ্ছেন, সেই সুযোগটা বাজারের স্বার্থে ব্যবহারের প্রতিজ্ঞা তাঁদের চোখেমুখে। তাঁদের দৌলতে বড় বড় বইমেলার অঙ্গ হিসেবে নানা ধরনের সাহিত্য সভাটভা হচ্ছে পর্যন্ত। বইকে ছুতো করে নানা ধরনের টিপ্পনীর সম্ভার, সব মিলিয়ে বইমেলার চরিত্র অন্য যে কোনও পার্বণ থেকে এখন আর আলাদা করা যায় না। মেলা উপলক্ষ করে কয়েকটা দিন ঘোরের মধ্যে কাটানো, সাড়ে বত্রিশভাজা উপভোগ। মেলায় জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার ব্যবস্থা, বিদগ্ধ ব্যক্তিদের যে-কোনও পার্থিব-অপার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা, খোঁজ নিয়ে দেখুন, অনেক মেলায় এখন সব ধরনের অনুষ্ঠানাদির আয়োজন হয়। যেমন কাচ্চাবাচ্চাদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা চলে, মেলা প্রাঙ্গণের এই ঘুপচিতে-ওই ঘুপচিতে এক জন-দু’জন জাদুকর জমিয়ে বসেন, অন্য এক কোণে শোনা যায় ঘোর বিপ্লবী রাজনৈতিক বক্তৃতার বহর, খাদ্যরসিকদের নানা বাহানা মেটানোর ব্যবস্থার তো কথাই নেই। কয়েকটা বছর ধৈর্য ধরে থাকুন, সরকার বাহাদুর রাজস্ব বাড়াবার মহান উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ পানীয়ের জন্য লাইসেন্স প্রথা চালু করে দেবেন হয়তো-বা। এক কথায় সব ছাপিয়ে নিজেদের দেখবার-দেখাবার উৎসব। ঝলমলে শাড়ি-গয়না-সালোয়ার, উঠতি কবি-সাহিত্যিকদের একান্ত আপন খুদে-পত্রিকার সমারোহ, তিথি মেনে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য পড়ি-কি-মরি প্রতিযোগিতা, বড়, মাঝারি, খুদে আরও খুদে বইয়ের স্টল, কম্পিউটারের প্রসাদে মরসুমের মেজাজের সঙ্গে খাঁজে খাঁজে মিলিয়ে গ্রন্থপ্রকাশের প্লাবন। লাউডস্পিকারে উচ্চনিনাদে রবীন্দ্রনাথের গানের দাপট তো আছেই। তেমন কেউ যে সেই গানে কান পাতছেন তা নয়, কিন্তু আবহ তো তৈরি হচ্ছে! আবহ তৈরি হচ্ছে বলেই কিনা কে জানে, একটু ছায়া ছায়া আলো-অন্ধকারে কোনও সদ্য-প্রস্ফুটিতা কিশোরী কারও পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কারের মুগ্ধতায় রূদ্ধবাক্।
অথচ বইমেলার সাম্রাজ্য যত বিস্তৃততর হচ্ছে বই পড়ার অভ্যেস ততই, আশঙ্কা হয়, অন্তর্হিত হচ্ছে। প্রকাশক-পুস্তকবিক্রেতারা এই মরসুমে প্রচুর ব্যবসা করেন, কিন্তু সম্ভবত মেলা উপলক্ষ করে আরও যাঁরা পসরা সাজিয়ে মেলাপ্রাঙ্গণেই জড়ো হন তাঁদের বিক্রিবাটার পরিমাণ ঢের বেশি। প্রধানত কোন ধরনের বই বিকিকিনি হয়, তা-ও তো আমাদের জানা। বড়লোকেরা কোনও কালেই বই কেনেন না। মেলার বর্বর ভিড়ে জুটে গিয়ে কেনার তো প্রশ্নই নেই। অন্য দিকে, গরিব নিম্নবিত্তের তো বই কেনার সংগতি নেই। উঠতি মধ্যবিত্তের জীবনবোধে বিপ্লব এসেছে। তাঁরা এমন ধরনের বই খোঁজেন যার সারবত্তা অনুধাবন করে কাজে লাগালে বই পড়ার প্রয়োজনই চিরতরে লুপ্ত হবে। সম্ভ্রান্ততর বইমেলায় ইতিমধ্যেই তো বৈদ্যুতিনগ্রন্থের উপস্থিতি একটু-আধটু টের পাওয়া যাচ্ছে।
বইমেলা জমছে, বাড়ছে, রাজ্য জুড়ে সাক্ষরতার হার পর্যাপ্ত ঊর্ধ্বগতি পাচ্ছে না। মেলাগুলি বিনোদন শিল্পে পরিণত। গরিবগুর্র্বোদের যেহেতু বিনোদনে অধিকার নেই, সাক্ষরতার বাইরেই তাঁদের অধিকাংশ থেকে যাচ্ছেন। ভারী ভারী বইমেলায় ভর-সন্ধ্যায় ঠাসা ভিড়ের সামনে মঞ্চে উপবিষ্ট পণ্ডিতজনেরা এন্তার ভারী ভারী বিষয়ে আলোক বিতরণ করেন। কিন্তু কোথাও সাক্ষরতার সঙ্গে গ্রন্থপাঠের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সামান্যতম আলোচনাও কানে আসে না। প্রতি বছর গোটা রাজ্যে অন্তত হাজারখানেক নানা পরিমাপের নানা ঘরানার পুস্তকমেলা অনুষ্ঠিত হয়, কলকাতায়, মফস্সল শহরে, গঞ্জে, বন্দরে, বনেবাদাড়ে। যদি প্রতিটি মেলার সঙ্গে নিরক্ষরতা দূরীকরণের একটি সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা যেত, আখেরে বই বেচনেওয়ালাদের লাভ বই ক্ষতি হত না। একটু গুছিয়ে ছক কেটে এগোলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-কর্তাদের সহযোগিতায় উৎসবের দিনগুলি জুড়ে মেলাপ্রাঙ্গণের ঈষৎ নিভৃত কোনও কোণে এ-রকম সাক্ষরতার পাঠশালার ব্যবস্থা করা নিশ্চয়ই সম্ভব। কয়েক লক্ষ নিরক্ষর নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-বালক-বালিকাদের ওই ক’দিন বইমেলার আশ্রয়ে নিয়ে এসে মজবুত অক্ষর-পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রবর্তন ঘটলে হুজুগ আর নিছক হুজুগ থাকত না। একটু সামাজিক দায়িত্ব পরিপূরণের স্পর্শ লাগত তাতে।
উদ্যোক্তারা সম্ভবত প্রস্তাবটি হেসে উড়িয়ে দেবেন। এমনিতেই মেলার ওই ক’টা দিন নাওয়া খাওয়া নেই, হাজার বায়নাক্কা সামলাতে হয়। পুলিশের-প্রশাসনের আইনকলা পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলা, ক্ষমতার উচ্চমার্গে বিহাররত সমাজ-বিরোধীদের নানা মর্জি ও বায়না মেটানো, আরও কত কী। এর মধ্যে গরিব-হাবড়াদের পাকড়ে এনে ক খ গ শেখানো এবং এটাকে তাঁদের কর্মসূচির মধ্যে ঢোকানো সম্ভবপর নয়। প্রযোজকরা না হয় মুখ ফিরিয়ে রইলেন, প্রশাসনের তরফ থেকেও কি কোনও উদ্যোগ নেওয়া যায় না? রাজ্যের সর্বত্র অধিকাংশ বইমেলা সরকারি খাস-জমি দখল করে অনুষ্ঠিত হয়। তার জন্য সরকার থেকে একটি মামুলি সম্মতিপত্র প্রয়োজন। সম্মতি দেওয়ার শর্ত হিসেবে প্রশাসনের তরফ থেকে কিছু কিছু বাধ্যতামূলক নির্দেশনামা স্বচ্ছন্দে যুক্ত করা যেতে পারে। সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ সেই তালিকার শীর্ষে ঢুকিয়ে দিতে কীসের অসুবিধা? সরকারকে একটু বাড়তি সক্রিয় হতে হবে মাত্র। শর্তটি যথাযথ পালিত হচ্ছে কি না তা নির্ণয় করে পরের বছর মেলার অনুমতি বাতিল করে দেওয়ার সতর্কবাণী ঘোষণাও এমন কিছু কঠিন নয়। অন্য কিছু মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হোক না হোক, প্রশাসনিক চাপ থাকলে মেলার উদ্যোক্তারা অন্তত লেখাপড়ার এবং বইয়ের উপযোগিতা নিয়ে নিজেরা শিক্ষিত হতে পারবেন।
এই মুহূর্তে বইমেলার সঙ্গে বিদ্যাচর্চার বড় অসদ্ভাব। যদি-মূর্খ-থাকতে-চাও-বইমেলায়-যাও গোছের নিন্দাবাদ যদি খানিকটা বন্ধ হয়, তা হলে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এ জগতে ক্ষতি কার?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.