কমল হাসান অভিনীত তামিল চলচ্চিত্র ‘বিশ্বরূপম্’ লইয়া জল ঘোলা করিবার বৃত্তান্ত এখনও অসমাপ্ত। চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের যোগ্যতা অর্থাৎ সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাইয়াছে। তামিলনাড়ুর প্রেক্ষাগৃহগুলিও প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু দুই-একটি সংগঠনের আপত্তি এবং তামিলনাড়ুর রাজ্য প্রশাসনের দুর্বলচিত্ততার ফলে বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে। আপত্তির কারণ, মুসলিমদের ইহাতে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে দেখানো হইয়াছে কিংবা বলা যায়, সন্ত্রাসবাদীরা এখানে মুসলিম হিসাবে চিত্রিত। বিষয়টি স্পর্শকাতর, এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে মুসলিমরা যেহেতু ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাই এ ধরনের চিত্রায়ন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির বিপজ্জনক আশঙ্কা লইয়া উপস্থিত হয়। সেই শঙ্কাই প্রবল আকার ধারণ করিয়াছে।
পরিস্থিতিটি দুর্ভাগ্যজনক। কমল হাসান একজন প্রবীণ চিত্রতারকা এবং পরিচালক। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অসাম্প্রদায়িকও বটেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আঘাত করার মতো কোনও কাজ যে তিনি সচেতনভাবে করিবেন না, সেই মর্মে রজনীকান্ত, অজিথ, ভারতী রাজা, শরৎ কুমার ও রাধিকার মতো প্রখ্যাত দক্ষিণী চলচ্চিত্রশিল্পীরাও শংসাপত্র দিয়াছেন। কমল হাসান নিজে সংখ্যালঘুদের সংশয় দূর করিতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার আগেই মুসলিমদের জন্য পৃথক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন, সেখানেও কোনও আপত্তি উচ্চারিত হয় নাই। তথাপি কিছু লোকের প্রতিবাদে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন ব্যাহত হইয়াছে। শিল্পী ও শিল্পকর্মের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব গণতন্ত্রে শিরোধার্য হইলেও কোনও সম্প্রদায়ই সহসা এই স্বাধীনতা মঞ্জুর করে না, যূথবদ্ধতার কাছে ব্যক্তি-শিল্পীকে নত হইতেই হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর তরফে সমালোচনা সম্পর্কে বর্ধমান অসহিষ্ণুতা শিল্পকলার স্বাধিকার খর্ব করে। আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিণ্ডে যখন দেশের নানা স্থানে সন্ত্রাসবাদী হামলার পিছনে ‘হিন্দু জঙ্গি’দের দোষারোপ করেন এবং সে জন্য আরএসএস ও সংঘ পরিবারকে দায়ী করেন, তখন সন্ত্রাসবাদীদের সাম্প্রদায়িক পরিচয় লইয়া তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গির গোলযোগ ধরা পড়ে। সন্ত্রাসবাদীর কোনও ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয় থাকিতেই পারে না, কেননা কোনও ধর্মই সন্ত্রাসবাদ অনুমোদন করে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংজ্ঞায়ন অতএব ভ্রান্ত। বিজেপির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও তাই অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু প্রতিবাদে সংসদ অচল করিয়া দেওয়া কিংবা দেশময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানোও মনে হয় হিন্দুত্ববাদীদের তরফে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া। এ ধরনের বাড়াবাড়িই কিন্তু অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি অকারণ বিদ্বেষ ও বিরূপতার উত্তেজনা জাগাইয়া তোলে। এই সব কিছুর পরিণামেই সমাজে অবাঞ্ছিত নানা ঘটনা ঘটিতে থাকে। সকলকেই তাই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। কমল হাসানের মতো প্রতিভাবান ও নন্দিত চলচ্চিত্রশিল্পীর দায় ও দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশি, কেননা তাঁহাদের শিল্পকর্মের প্রভাব অন্য শিল্পীদের তুলনায় অধিকতর। |