|
|
|
|
বাজেট প্রস্তুতি |
জনমোহিনী হওয়াই
পরীক্ষা চিদম্বরমের
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
|
|
জেকব লিউ ও পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম।
প্রথম জনকে সদ্য মার্কিন অর্থসচিবের পদে বসিয়েছেন বারাক ওবামা। দ্বিতীয় জনের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নতুন ইনিংসের প্রথম বাজেট। চ্যালেঞ্জটা দু’জনের সামনেই এক। আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে ধারকর্জ বাড়ালে চলবে না। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সর্বোপরি মানুষের হৃদয় জয়ে জনমোহিনী কর্মসূচিতে টাকা ঢালতে হবে। ওবামা তা-ও সদ্য ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু মনমোহন সিংহের সরকারের শিয়রে নির্বাচন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে এটাই তাঁর সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি চিদম্বরম যখন ২০১৩-’১৪ সালের বাজেট পেশ করবেন, তখন কোনও ভাবেই তাঁর পক্ষে রাজনীতির কথা ভুলে শুধুই অর্থনীতির যুক্তি মেনে চলা সম্ভব হবে না।
জনমুখী প্রকল্পে টাকা আসবে কোথা থেকে, সেটাই হল প্রশ্ন। কারণ, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে গেলে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ। খরচ করতে গেলে রাজস্ব আয়ও বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু শিল্পায়নের গতি কমে যাওয়ায় রাজস্ব আয়ও কম হচ্ছে। তাই বাড়ছে ঘাটতি। চলতি অর্থবর্ষের রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা প্রথমে ধরা হয়েছিল ৫.১%। পরিস্থিতির চাপে তা বাড়িয়ে ৫.৩% করতে হয়েছে। ঘাটতি কমানোর আর একটি উপায়, ভর্তুকি ছাঁটাই। কিন্তু ভোটের বছরে রান্নার গ্যাস-কেরোসিন থেকে শুরু করে খাদ্য বা সারে ভর্তুকি আরও কতটা কমানো যাবে, ডিজেলের সম্পূর্ণ বিনিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। গত বারও ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া যায়নি। এ বছর ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে চিদম্বরম বদ্ধপরিকর।
কী ভাবে তা সম্ভব? এমনিতেই বাজেটের বহর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মনমোহন সিংহের আর্থিক সংস্কারের প্রথম যুগে, ১৯৯০-’৯১ সালে মোট বাজেট ব্যয় ছিল ৯৮ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা ছুঁতে চলেছে। যার মধ্যে খাদ্য-সার-পেট্রোপণ্যে ভর্তুকির পরিমাণ পৌনে দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি। সমস্যা হল, ভর্তুকির বোঝা বাড়লেও পরিকাঠামোর মতো স্থায়ী সম্পদ তৈরির জন্য সরকারি ব্যয় কমেছে বই বাড়েনি। সে সময় মোট বাজেটের ২৫% স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে ব্যয় হলে এখন হচ্ছে ১৩-১৪%। অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “বাজার থেকে ধার করে সরকারি ব্যয় বাড়ানো যায়। কিন্তু সরকারই সব টাকা তুলে নিলে বেসরকারি সংস্থাগুলি কোথা থেকে পুঁজি পাবে? তাদেরও তো বাজার থেকে ঋণ নিয়েই পুঁজির সংস্থান করতে হয়।” উল্টো দিকে, রাজস্ব আয়ের বিশেষ উন্নতি হয়নি। অর্থমন্ত্রী মনমোহনের জমানায় কর বাবদ আয়ের পরিমাণ জিডিপি বা মোট জাতীয় আয়ের ১০ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করত। এখনও তাই।
তা হলে ঘাটতিকে কী ভাবে লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে রাখা সম্ভব? অর্থ মন্ত্রকের বিভিন্ন দফতরের সচিবরা হিসেবনিকেশের পর দাবি করছেন, অন্তত চলতি অর্থবর্ষে সেটা সম্ভব। প্রথম কারণ, বিলগ্নিকরণ থেকে ৩০ হাজার কোটি এবং স্পেকট্রাম নিলাম করে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘরে তোলার বিষয়ে তাঁরা আশাবাদী। প্রথম দফায় টু-জি স্পেকট্রাম নিলাম করে ৯,৪০০ কোটি টাকা মিলেছে। ৩১ মার্চের আগে দ্বিতীয় দফার নিলাম হবে। অন্য দিকে, বিভিন্ন মন্ত্রকের যোজনা খাতে যে বরাদ্দ হয়েছিল, তারও অনেকটা বেঁচে যাবে। যার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। মন্ত্রকগুলি সামাজিক উন্নয়ন ও পরিকাঠামো খাতে এই পরিমাণ টাকা এখনও খরচ করতে পারেনি। সাধারণত শেষ দিকে টাকা থাকলে তাড়াহুড়ো করে বেশ কিছু প্রকল্পের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু এ বার ব্যয় সঙ্কোচে তৎপর অর্থ মন্ত্রকের নির্দেশ, শেষবেলায় তাড়াহুড়ো করে বাকি টাকা একসঙ্গে খরচ করে ফেলার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া, আগামী বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ কাটছাঁট করা নিয়েও দর কষাকষি চলছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও ইন্দিরা আবাস যোজনার মতো বিভিন্ন প্রকল্পে যতটা সম্ভব রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করছেন চিদম্বরম।
কিন্তু এই ধরনের প্রকল্পে খরচ কমালে আমজনতার মন কী ভাবে জয় করবে মনমোহন সরকার? সেই লক্ষ্যে তাদের পরিকল্পনা, বন্যা ও খরাপ্রবণ এলাকায় জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের আওতায় কাজ একশো দিন থেকে বাড়িয়ে দেড়শো দিন করা। খাদ্য সুরক্ষা আইন তো রয়েইছে। এ ছাড়া, ভর্তুকি-মূল্যে রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা ছ’টি থেকে বাড়িয়ে ন’টি করেছে সরকার।
চিদম্বরম জানেন, রাজনৈতিক চাপের সামনে তাঁকে মাথা নোয়াতেই হবে। তাই রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। কোন রাস্তায় আয় বাড়তে পারে? অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। এক, উৎপাদন শুল্ক ও পরিষেবা করের হার ২% বাড়ানো। এই পথে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে। তবে তাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। দুই, দু’বছর আগে অশোধিত তেলের উপর আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়া হয়েছিল। তা ফের বসানো যায়। কিন্তু বাড়তি করের জন্য তেলের দাম না বাড়লে, সরকারকেই বেশি ভর্তুকি গুণতে হবে। তিন, সোনার উপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো, যা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে সরকার। চার, অকৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে আর কমানোর প্রয়োজন নেই। পাঁচ, আয়কর ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বদলেরও প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজন সব থেকে ধনীদের
জন্য আয়করের হার বাড়ানোর
প্রস্তাব দিয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির উপরেও কর বসানোর প্রস্তাব রয়েছে।
এর পাশাপাশি ঘাটতি কমানোরও ব্যবস্থা হয়েছে। ডিজেলের বিনিয়ন্ত্রণ এবং রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি-সিলিন্ডার বেঁধে দেওয়ার ফলে ভর্তুকি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ফলে ঘাটতিও লক্ষ্যণীয় ভাবে কমবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু চিদম্বরম জানিয়েছেন, এর ফলে কত ভর্তুকি সাশ্রয় হবে, তা আসন্ন বাজেটে ধরা হবে না। আর এ সবের ফলে যখন তেল সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম বাড়ছে, তখন অয়েল ইন্ডিয়ায় আংশিক বিলগ্নিকরণেরও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। তাদের আশা, এর ফলে মোটা অঙ্কের টাকা তোলা সম্ভব।
কিছু দিন আগে চিদম্বরম বলেছিলেন, অর্থনীতির অসুখ সারাতে তেতো ওষুধ গেলানোর প্রয়োজন। তাতে প্রাথমিক ভাবে একটু যন্ত্রণা হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বাজেটে কতটা তেতো দাওয়াই দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী, সেটাই এখন দেখার। |
|
|
|
|
|