গণ্ডগোল আপাতত সামাল দেওয়া গিয়েছে। বুধবার শান্তিতেই কাজ হল কাঁকসায় এসার অয়েলের কোল বেড মিথেন প্রকল্প এবং বুদবুদে ম্যাটিক্সের সার কারখানায়। ফলে, পানাগড় শিল্পতালুকে আশঙ্কার যে ছায়া ঘনাচ্ছিল তা অনেকটাই ফিকে হয়েছে।
কাঁকসার জাটগোড়িয়ায় রাস্তা আটকে যে বেড়া দেওয়া হয়েছিল, মঙ্গলবার রাতে জেলাশাসকের দফতরে এসারের প্রতিনিধির সঙ্গে জমিমালিকদের বৈঠকে সমাধানসূত্র মিলতেই তা রাস্তা খুলে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ জানান, গ্রামের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচলে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। প্রকল্পের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে। তবে জমি মালিকদের একাংশের হুঁশিয়ারি, কাল, শুক্রবারের মধ্যে প্রাথমিক নড়াচাড়া শুরু না হলে শনিবার থেকে ফের তাঁরা আন্দোলনে নামবেন।
বড় রাস্তা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার মোরাম রাস্তা পেরিয়ে জাটগোড়িয়ায় এসারের ভূগর্ভস্থ মিথেন গ্যাস তোলার প্রকল্প এলাকায় পৌঁছতে হয়। সেই রাস্তার কিছু জমি এখনও ব্যক্তি মালিকানাধীন। বাণিজ্যিক কাজে এসারকে সেই রাস্তা ব্যবহার করতে দিতে নারাজ তাঁরা। এই নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই চাপানউতোর চলছে। শেষমেশ তৃণমূলের নেতৃত্বে দিন চারেক আগে বেশ কিছু গ্রামবাসী বেড়া দিয়ে রাস্তা ঘিরে দেন। গাড়ি চলাচল আটকে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সোমবার কিছু কর্মী প্রকল্প এলাকায় কাজে যাওয়ার সময়ে গ্রামবাসীরা তাঁদের গাড়ি আটকে দেন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। |
এসার কর্তৃপক্ষের তরফে কর্মীদের ‘অপহরণ’ করা ও পরে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় হইচই শুরু হয়ে গিয়েছিল। মঙ্গলবার শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে অবশ্য এসার কর্তারা সেই অভিযোগ থেকে সরে আসেন। যথাযথ ‘ক্ষতিপূরণ’ দিয়ে জমি কিনতে রাজি বলেও তাঁরা জানিয়ে দেন। মঙ্গলবার রাতে জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা নিজের দফতরে জমিমালিকদের তরফে পাঁচ জন, এসারের এক প্রতিনিধি, কাঁকসার বিডিও এবং কাঁকসা থানার ওসিকে নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে ঠিক হয়, বাজারদরে জমির মূল্য চোকাবে এসার। রাতেই রাস্তা খুলে দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসার কর্তৃপক্ষ জমিমালিকদের থেকে মালিকানার কাগজপত্র নিয়ে বিডিও-র কাছে তা জমা দেবেন। তার পরে প্রশাসন জমি মাপজোকের ব্যবস্থা করে জমিমালিকদের নাম-পরিচয় ও জমির আয়তন নির্দিষ্ট করবে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মাসখানেক লাগবে। দুর্গাপুর মহকুমা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক তথা জাটগোড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা সরিফ মণ্ডল জানান, এসার কর্তৃপক্ষই সরাসরি জমিমালিকদের হাতে চেক তুলে দেবেন। তবে বিষয়টি গোটাতে এসার তথা প্রশাসন দেরি করলে ফের সমস্যা দানা বাঁধতে পারে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানিয়ে দিয়েছেন।
এসারের কর্মীরা যে দিন বেড়ার কাছে আটকে পড়েছিলেন, সেই সোমবার সকালেই বুদবুদের পন্ডালি মৌজায় ম্যাটিক্সের নির্মীয়মাণ সার কারখানার গেটে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন দেখান স্থানীয় জমিদাতাদের একাংশ। সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট সুবালক সরকার বাইরের একটি গাড়িতে চেপে ভিতরে ঢুকছিলেন। গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বুদবুদ থানা থেকে বিশাল বাহিনী গিয়ে মধ্যস্থতা করে সমস্যা মেটায়।
জমিদাতা পরিবারের বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, রোজগারের আশায় প্রায় ছ’শো জমিদাতা পরিবার একটি সংস্থা গড়ে কারখানায় গাড়ি সরবরাহ করে। তাদের বেশির ভাগই জমি বিক্রির টাকায় গাড়ি কিনেছে। গড়ে প্রতি দিন ৬-৭টি গাড়ি কারখানায় খাটে। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বাইরে থেকে ৯টি গাড়ি এনেছেন। সুবালকবাবুকে আটকে জমিদাতারা জানিয়ে দেন, বাইরের গাড়ি তাঁরা চলতে দেবেন না। তাঁদের কাছ থেকেই গাড়ি নিতে হবে। এই নিয়ে গণ্ডগোলের জেরে নির্মাণকাজ বন্ধ না হলেও শিল্পমহল আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তার মধ্যেই এসারের ঘটনাটি প্রকাশ্যে চলে আসে। |
বুদবুদে ম্যাটিক্সের কারখানার গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। সেখানে উত্পাদনের জন্য কোল বেড মিথেন (সিবিএম) গ্যাস সরবরাহ করার দায়িত্বে আছে এসার অয়েল। আবার এসার প্রজেক্ট সংস্থা কারখানা নির্মাণের বরাত পেয়েছে। প্রায় ৪১৯ একর জমিতে সার কারখানাটির নির্মাণ চলছে। বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪৮০০ কোটি টাকা। এর আগেও মাঝে-মধ্যেই কারখানার গেটে বিক্ষোভ হয়েছে। জমিদাতারা জমির দাম পেয়ে গেলেও বর্গাদার ও খেতমজুরদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দাবিদাওয়া জানানো হয়েছে। পরে সেই সমস্যা অনেকটা মিটে গেলেও প্রতিটি জমিদাতা পরিবারের এক জনকে কারখানায় কাজ দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। তার পরে আবার গাড়ি নিয়ে গণ্ডগোল।
ম্যাটিক্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিকের মতে, “যে ভাবে বারবার কারখানায় নানা অছিলায় বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে, তা মোটেই কাম্য নয়। এতে কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।” তবে মঙ্গলবার থেকে কোনও ঝামেলা আর বাধেনি। কাজও হচ্ছে স্বাভাবিক গতিতে। এ দিন দুপুরে কারখানার গেটে গিয়ে দেখা যায়, নিরাপত্তার ব্যাপক কড়াকড়ি। এক মাত্র কর্মীরাই নির্দিষ্ট ‘গেট পাস’ দেখিয়ে লাইন দিয়ে ঢুকছেন। ভিতরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সশব্দে নির্মাণকাজ চলছে। বিক্ষোভকারীদের তরফে কিষাণ কর্মকার বলেন, “আপাতত সমস্যা মিটে গিয়েছে। আমাদের কাছে অতিরিক্ত গাড়ি নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।”
ম্যাটিক্সের এই সার কারখানা এই মুহূর্তে রাজ্যের অন্যতম বড় প্রকল্প। আবার ম্যাটিক্স-সহ পানাগড় শিল্পতালুকের বহু প্রস্তাবিত কারখানাই জ্বালানি হিসেবে এসারের মিথেন ব্যবহারে আগ্রহী। অশান্তির কারণে যাতে তাদের কাজ বাধা না পায়, তা নিশ্চিত করাই এখন প্রশাসনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
|