|
|
|
|
বিভ্রান্তি, দ্বিধায় চেতি, ইন্দিরারা |
কিশোর সাহা ও অনির্বাণ রায় • দার্জিলিং |
চেতি শেরপা তিন দশকের গোর্খাল্যান্ডের অনেক আন্দোলন দেখেছেন। ইন্দিরা সুব্বা, মনিরাম গজমেরাও অনেক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। অতীতে সুবাস ঘিসিঙের সঙ্গে পথ চলার পরে পার্বত্য পরিষদ গঠন হলে অনেক আশায় বুক বেঁধেছিলেন ওঁরা। কিন্তু জমির পাট্টা-সহ কোনও সুবিধাই শেষ পর্যন্ত পাননি। ঘিসিং জমনার অবসান হলে বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে পা মিলিয়ে অনেক পথ হেঁটেছেন ওঁরা। শেষ পর্যন্ত গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) গঠনের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সেই স্বপ্ন পূরণের আশায় ওঁরা মঙ্গলবার হাজির হয়েছিলেন দার্জিলিঙের ম্যালে। কারণ, এদিন যে ক’জন ঘরের চাবি এবং পাট্টা পেয়েছেন, তাতে তাঁদেরও নাম ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পাট্টাও পেয়েছেন।
কিন্তু পাট্টা পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আচমকা সভামঞ্চের আশপাশ থেকে যেভাবে গোর্খাল্যান্ডের স্লোগান উঠেছে, তাতে ওঁরা অনেকেই হকচকিয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ বিভ্রান্ত। কেউ দ্বিধাগ্রস্থ। কার্শিয়াঙের জ্যোতিমায়া লামা, কালিম্পঙের সাবির গজমের এবং সুখিয়াপোখরির পূর্ণমায়া সোনামেরা প্রায় একই সুরে বললেন, “আন্দোলন করতে করতে আমরা ক্লান্ত। জিটিএ গঠনের পরে পাহাড়ে ব্যবসা বাণিজ্য ভাল হচ্ছে। আমাদের আয়ও বেড়েছে। এখন আবার আন্দোলন হলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সত্যিই আবার আন্দোলন শুরু হলে কী যে হবে!”
পাশে দাঁড়ানো ইন্দিরা সুব্বা, দোর্জি পেম্বা শেরপারা অবশ্য তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। দুই জনের মোর্চার সক্রিয় কর্মী। দুজনেই বললেন, “আমাদের হৃদয়ে গোর্খাল্যান্ড আছে। সেটা যখন হওয়ার হবে। তা বলে দিনের পর দিন ভূমিহীন, গৃহহীন হয়ে থাকা যায়। সরকারি সুযোগ সুবিধা নিতে হবে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলব কেন? নেতাদের বোঝাতে হবে পাহাড়কে অস্থির না করেও তো আন্দোলন করা যায়। জিটিএ-র পুরো সুযোগ সুবিধা নিয়ে নিতে হবে।”
বস্তুত, পাহাড়ের তিন মহকুমার দারিদ্রসীমার কাছেপিঠে থাকা মানুষের ভাবনার প্রতিফলনই যেন ধরা পড়েছে ইন্দিরা দেবীদের কথায়। সেই কথা মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা অনেকে মানছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা অনুষ্ঠানস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, “জিটিএ-র মাধ্যমে যা যা উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে তা করা হবে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। রাজনৈতির বাধ্যবাদকতার জেরে অনেক কিছুই আমাদের করতে হচ্ছে।” খোদ মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গকেও নেতা কর্মীদের শান্ত করতে গিয়ে বলতে শোনা গিয়েছে, “দুশ্চিন্তার কিছুই নেই।”
পাহাড়ে জিটিএ গঠনের পরে প্রধানত চারটি বিষয় জোর দেয় রাজ্য সরকার। সেগুলি হল-যোগাযোগ, পর্যটন, স্বাস্থ্য ও কর্ম সংস্থান। সেই অনুযায়ী ১৮ কোটি টাকায় রোহিণীর রাস্তার সিংহভাগই সারানো হয়েছে। পাহাড়ে লামাহাটা, তাকদা নতুন পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে। লামাহাটা কেন্দ্রটি মুখ্যমন্ত্রী এদিন উদ্বোধন করেছেন। দার্জিলিং।, কালিম্পং, কার্শিয়াং হাসপাতালে জন্য কয়েক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। মিরিকে পর্যটন কটেজ হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ের তিন মহকুমায় আইটিআই-র কাজ শুরু হয়েছে। একটি মেডিক্যাল কলেজ করার জন্য কার্শিয়াঙে জমি চিহ্নিত হয়েছে। দার্জিলিঙের হেলিপ্যাডের কাজ এগোচ্ছে। সান্দাফু রুট পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় করতে মুখ্যমন্ত্রী আলাদা বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রত্যন্ত এলাকায় ভূমিহীন এবং দরিদ্র বাসিন্দাদের পাট্টা বিলি ও ঘর তৈরি করে দেওয়ার প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি, দার্জিলিং পুলিশের অধীনে ভিলেজ পুলিশ পদে নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। প্রথম পর্বে এদিনই ৫৫ জনকে প্রশিক্ষিত যুবক যুবতীকে ভিলেজ পুলিশ হিসাবে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৭৫ জনকে নিয়োগ করা হবে। সেই সঙ্গে দার্জিলিং এবং কার্শিয়াঙে আইটি হাব তৈরি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্র মিলিয়ে অন্তত ১০ হাজার জনের সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে সরকার মনে করে। পরোক্ষভাবে তা ৫০ হাজার ছড়িয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “গত দেড় বছরের মধ্যে পাহাড়ে পর্যটনের সুবাদে যা ব্যবসা হয়েছে তা রেকর্ড।”
আর উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেছেন, “পাহাড়ের মানুষ রাজনৈতিক দাবি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। গত কয়েক বছর ধরে ঘনঘন পাহাড়ে যাতায়াতের সুবাদে বুঝেছি, এখানকার মানুষের অগ্রাধিকারের তালিকার প্রথমেই রয়েছে উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান। সেটা করার মত ক্ষমতা জিটিএকে দেওয়া হয়েছে। বাদ বাকি সব কাজ রাজ্য সরকার করবে। পাহাড়ের মানুষ তা বুঝতে পারছেন। সেটা আশার কথা।” |
|
|
|
|
|