হাসির পাহাড়ে ছন্দপতন
মমতার সামনেই গোর্খাল্যান্ডের দাবি, গুরুঙ্গের গলাতেও ক্ষোভ
দার্জিলিঙে ছন্দপতন!
এত দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে গেলে যাত্রাপথ থেকেই শুরু হয়ে যেত অভ্যর্থনা। মঞ্চে থাকত সৌহার্দ্যের পরিবেশ। মমতাও বলতেন, ‘পাহাড় হাসছে’।
কিন্তু মঙ্গলবার ম্যালে উত্তরবঙ্গ উৎসবের দার্জিলিং পর্বের সূচনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আচমকাই সেই সুর কেটে গেল। মুখ্যমন্ত্রী যখন সবে বক্তৃতা শেষ করে আসনে বসেছেন, মঞ্চের সামনেই মোর্চা সমর্থকরা পতাকা উঁচিয়ে স্লোগান তুললেন “জিটিএ নয়, উন্নয়ন নয়, গোর্খাল্যান্ড চাই।” ছিল একটি পোস্টারও। হকচকিয়ে যান অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, অস্বস্তিতে পড়েছেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গও। মমতা দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ।
পরিস্থিতি তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুরুঙ্গ প্রথমে হাত উঁচিয়ে সকলকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। তাতে কাজ না-হওয়ায় উঠে যান মাইকের সামনে। তাতেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। তখন চকিতে উঠে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। গুরুঙ্গের হাত থেকে কর্ডলেস মাইক্রোফোনটা কার্যত কেড়ে নিয়ে মোর্চা সমর্থকদের হুঁশিয়ারি দিয়েই তিনি বললেন, “শুনুন, চেঁচামেচি করবেন না। এটা সরকারি অনুষ্ঠান। এখানে রাজনৈতিক স্লোগান দেবেন না। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু রাফ অ্যান্ড টাফ।”

উত্তরবঙ্গ উৎসবের মঞ্চে বিমল গুরুঙ্গ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরিস্থিতি তার পরে শান্ত হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কয়েক মিনিটের মধ্যেই মঞ্চ থেকে নেমে পড়েন। পিছন পিছন নামেন গুরুঙ্গও। মমতা গিয়ে বসেন দর্শকদের সামনের সারিতে। তাঁর বাঁ-পাশে বসেন গুরুঙ্গ। অনুচ্চ স্বরে মমতাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। মিনিট কুড়ি পরে মুখ্যমন্ত্রী যখন সভাস্থল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন কিন্তু আবার স্লোগান ওঠে ‘গোর্খাল্যান্ড চাই।’ এই ঘটনার জেরে এ দিন গুরুঙ্গের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাব্য বৈঠকও ভেস্তে যায়।
সিপিএম এই ঘটনাকে মুখ্যমন্ত্রীর বিড়ম্বনা বলেই দেখছে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন আলিমুদ্দিনে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী জিটিএ চুক্তি করে সদর্পে বলেছিলেন, পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করে দিলাম। আমরা তখনই বলেছিলাম, এ ভাবে সমাধান করা যাবে না। কারণ গোর্খাল্যান্ড যে চূড়ান্ত লক্ষ্য, তা চুক্তির মধ্যেই মেনে নেওয়া হয়েছে।” জিটিএ চুক্তির মধ্যেই গোর্খাল্যান্ডের বীজ রয়েছে, তা জানিয়ে বিমানবাবু বলেন, “বীজ থাকলে এক দিন তা অঙ্কুরিত হবেই। তাই হয়েছে।”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিনের সভায় বলেছেন “এটা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চাই, দার্জিলিং আমাদেরই অংশ।” কিন্তু মোর্চা যে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে অনড়, তার প্রমাণ মিলেছে এ দিন দিল্লিতে বিজেপি-র বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে দলীয় নেতাদের দেখা করার মধ্যেও। তবে ছোট রাজ্যের দাবির প্রতি দলগত দায়বদ্ধতা থাকলেও লোকসভা ভোটের আগে মমতাকে অসন্তুষ্ট করে মোর্চার আন্দোলন সমর্থন করার অঙ্গীকার করেনি বিজেপি।
সরকারি মঞ্চে রাজনীতির কথা বলবেন না, মমতার এই বক্তব্যকেও এ দিন কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “উনি আজ যেটা বললেন, সেটাই দিনের পর দিন করছেন।” আর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির কটাক্ষ, “এই উদাহরণ তো মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের নেতারাই তৈরি করেছেন।” গুরুঙ্গও বলেছেন, “সরকারি মঞ্চে রাজনৈতিক কথা তো ওঁরাও বলেন।”

গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পোস্টার। মুখ্যমন্ত্রীর সভায়। —নিজস্ব চিত্র
মমতা এ দিন ধমক দিয়ে মোর্চা কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করলেও ম্যালের সভার তাল কাটতে শুরু করে গুরুঙ্গের একটি বক্তব্য থেকেই। মুখ্যমন্ত্রী এই দিনের সভায় পাট্টা বিলি করেছেন, বিভিন্ন প্রকল্পের চেক ও গৃহনির্মাণ প্রকল্পে ঘরের চাবি তুলে দিয়েছেন স্থানীয় কয়েক জনের হাতে। গুরুঙ্গ মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই অভিযোগ করেন, যাঁদের হাতে চেক বা চাবি তুলে দেওয়া হল, তাঁদের বাছাই করা হয়েছে জিটিএ-কে না জানিয়েই। অথচ, জিটিএ-র হাতেই রয়েছে ভূমি ও তা সংক্রান্ত যাবতীয় প্রকল্প। তবে সেই দায়ভার তিনি তখন চাপিয়ে দিয়েছিলেন জিটিএ-র প্রধান সচিব তথা দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্রমোহনের উপরে। মমতাও অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, “প্রধান সচিবকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরই সমন্বয়ের কাজ করেছে। এখানে ওঁদের (গুরুঙ্গদের) বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা কোনও বড় বিষয়ই নয়।”
মমতার বক্তব্য, পাহাড় যাতে অশান্ত না হয়, সেটাই প্রধান বিষয়।
না হলে গত দেড় বছরে পাহাড়ে যে পর্যটন-সহ নানা ব্যবসার প্রসার ঘটছে, তা ব্যাহত হবে। তাঁর কথায়, “মনে রাখবেন আমি দার্জিলিং দখল করতে আসি না। বছরে অন্তত দু’বার আসি, যাতে কাজগুলো ঠিকঠাক হয়ে যায়। মনে রাখবেন দার্জিলিংয়ে জিটিএ-ই সব করবে। তবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সব হবে। আপনাদের কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন।”

ব্যস্ততা। ল্যাপটপ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার জলপাইগুড়িতে সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় কালিম্পংয়ের দিকে চলে যাওয়ার পরেই দলের নেতা-কর্মীরা কার্যত ঘিরে ধরেন গুরুঙ্গকে। তাঁকে প্রশ্ন করতে থাকেন, কারা কোন প্রকল্পে সুবিধা পাবেন, তা কেন জিটিএ ঠিক করবে না? বাছাই করা নেতাদের সঙ্গে নিয়ে গুরুঙ্গ তখন কাছে একটি হোটেলে গিয়ে আলোচনায় বসেন। তার পরে সাংবাদিকদের বলেন, “সাধারণত এই ধরনের প্রকল্পের সুবিধা কারা পাবেন, তা স্থির করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই। কিন্তু প্রধান সচিব তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনাই করেননি। সে কথা আমি মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই মঞ্চে তুলেছিলাম।” কিন্তু তার পরেও কেন ফের মোর্চা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ল? গুরুঙ্গের বক্তব্য, “আমাদের হৃদয়ে গোর্খাল্যান্ডও তো আছে। তাই ক্ষোভ প্রকাশ পেয়ে যেতেই পারে।”
তবে মোর্চার অভিযোগ উড়িয়ে সৌমিত্রমোহনের বক্তব্য, “মোর্চার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেই মুখ্যমন্ত্রী কাদের হাতে পাট্টা, চাবি বা চেক তুলে দেবেন তার তালিকা স্থির হয়েছিল।” জিটিএ সূত্রে খবর, সৌমিত্রমোহনের সঙ্গে সম্প্রতি মোর্চা নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “আমাদের সব কিছুই নজরে রয়েছে। যথাসময়ে যা বলার বলব। এটুকু বলতে পারি, পাহাড়ে উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটাতে কেউ চেষ্টা করলে, তিনি যে তা সহ্য করবেন না, তা এই দিন মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার করে দিয়েছেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.