প্রবন্ধ ২...
এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়
দুইয়ে পক্ষ। দুইয়ে দ্বন্দ্ব। দুইয়ে সন্ধিও। একক অস্তিত্বের সঙ্গে অন্য একটি একক অস্তিত্ব যুক্ত হলে, হরেদরে দু’টি পক্ষ উৎপন্ন হয়। সেই দুই পক্ষের মধ্যে যেমন সখ্য বা সন্ধি সম্ভব, তেমন দ্বন্দ্বও সম্ভব। ইতিহাসের পাতায় এমন এক-একটি বন্ধুতা বা শত্রুতা ফিরে-ফিরে দেখা গিয়েছে। দু’টি ব্যক্তিত্ব পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি তৃতীয় সত্তার জন্ম দেয়, এ-ও অসম্ভব নয়। কিন্তু তৃতীয় এই সত্তার সীমা কে-ই বা নির্ধারণ করবে? সীমারেখা পার হওয়ার বিন্দুটিকে নিয়েই যে বহুবার রচিত হয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস, এবং এক হিসেবে সন্ধিরও, তা অজানা নয়।
জাঁ পল সাত্রর্ এবং আলবেয়ার কাম্যু। প্রথম জনের বয়ঃসীমা ১৯০৫ থেকে ১৯৮০। দ্বিতীয় জনের ১৯১৩ থেকে ১৯৬০। মোটামুটি একই সময়ে সাত্রর্ ও কাম্যু এই ধরায় বিচরণ করেছিলেন। তাঁদের দেখাও হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে প্যারিসে সাত্রর্-এর ‘দ্য ফ্লাইজ’ (লে মুশ) নাটকের প্রথম প্রদর্শনের সময়। সিমোন দ্য বোভোয়া লিখেছেন, সার্ত্র্ প্রদর্শনশালার লবিতে দাঁড়িয়ে থাকার সময় একজন ‘ডার্ক স্কিনড’ তরুণ এসে নিজেই তাঁর ও সাত্রর্-এর সঙ্গে আলাপ করেন। তিনিই আলবেয়ার কাম্যু। কাম্যুর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ ও ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’ তখন প্রকাশিত হয়েছে। যদিও কাম্যু আসলে আলজিরিয়ান, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফাঁদে পড়ে ফ্রান্সে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। সেই থাকা শাপে বর হয়ে উঠতে উঠতেও কীভাবে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, তার পাঁচালিও কাম্যু-সাত্রর্-এর বন্ধুতা ও পরবর্তী কালে তাঁদের মতপার্থক্যের মধ্যেই ন্যস্ত। সাত্রর্ তখন ক্রমশ বিখ্যাত হতে থাকা দার্শনিক, ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার। সেই প্রথম আলাপ কিন্তু একটি বাক্যের বেশি এগোয়নি, তবে সাত্রর্-এর পছন্দ হয়েছিল কাম্যুকে। সেই বছরেরই শেষ দিকে দু’জনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠে। প্যারিসের কাফে দ্য ফ্লোর-এ জমে উঠতে থাকে সাত্রর্, বোভোয়া ও কাম্যুর আলাপ।
বক্সার ও গোলকিপার। জাঁ পল সার্ত্র্ এবং আলবেয়ার কাম্যু।
অ্যান্ডি মার্টিন এখান থেকে শুরু করেছেন দুই সাহিত্যিক-দার্শনিকের উপাখ্যান। আলাপচারিতার ভঙ্গিতে, সহজ গদ্যে তিনি দুই প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের কথা বলে গিয়েছেন, এমন দুই মানুষ যাঁরা না থাকলে গত শতাব্দীর দর্শন ও সাহিত্য অন্যরকম হতে পারত। বলার ভঙ্গিতে তিনি জুড়ে নিয়েছেন নিজের উপাদেয় অভিজ্ঞতা ও ভাবনা। নিউইয়র্কের একটি কাফেতে বসে ছাত্রদের ল্যাপটপে টাইপিংয়ের আওয়াজ শুনতে-শুনতে লেখক প্যারিসের তৎকালীন কফিশপের সঙ্গে (কাফে দ্য ফ্লোর) সমান্তরাল রেখা টানতে থাকেন মানসিকভাবে। পাঠকেরও মনে পড়ে যায় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস নিয়ে গড়ে ওঠা কলকাতার নিজস্ব মিথোলজি। প্রথমে লেখক যোগসূত্র টানেন সাত্রর্-এর লেখা ও দর্শনের সঙ্গে কাফের উদাসীন অথচ মুখর আবহের, যে আবহকে ভিত্তি করে সাম্প্রতিককালে লেখালিখি করেছেন জে কে রাওলিং-ও। তার পর মার্টিন তুলনা করেছেন নিজস্ব পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নাত্সি অধিকৃত প্যারিসের কাফের: “Thinking and conversation: as integral to the cafe as cups and saucers. The very sounds and sights of the cafe illustrate philosophical arguments. The cafe is shot through in its every atom with the themes of being and nothingness.”
বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস। অস্ত্বিত্ব ও শূন্যতা। অথবা বলা যেতে পারে অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতা। কাম্যুর জীবনে সার্ত্র্-এর এবং সাত্রর্-এর জীবনে কাম্যুর অস্তিত্ব কতখানি, কতখানিই বা সেই অস্তিত্বের অভাব, তা নিয়েই অ্যান্ডি মার্টিনের বই। তিনি খুঁটিনাটি দেখতে দেখতে এগিয়েছেন দুই প্রতিভাধরের জীবনের জানা অংশটুকু নিয়ে। বছর ধরে-ধরে ধারাবিবরণ দিয়েছেন তাঁদের আলাপচারিতার। পরস্পরের লেখা সম্পর্কে তাঁদের লিখিত মত উদ্ধৃত করেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের চিন্তার মিল ও অমিলের দিকেও তর্জনী তুলেছেন। কাম্যু সাত্রর্-এর ‘নো এগজিট’ নাটকে অভিনয় করতে রাজি হয়েছিলেন। এই নাটকের সূত্রেই দু’জনের খুব অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের শুরু। কিন্তু যুদ্ধকালীন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে নাটকের শখের অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। পেশাদারভাবে প্যারিসের স্টেজে নাটকটি অভিনীত হবে, এমন কথা জেনে কাম্যু নিজেই পিছিয়ে যান। অর্থাৎ কাম্যু ও সাত্রর্ তখন পরস্পরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে নিরত। তাঁরা আলাপ হওয়ার আগে থেকেই পরস্পরের গুণমুগ্ধ ছিলেন। দেখা হওয়ার আগেই ‘নসিয়া’ পড়ে কাম্যু সমালোচক হিসেবে লিখিতভাবে তাঁর প্রশংসা জানিয়েছিলেন। তেমন, সাত্রর্ও ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ সম্পর্কে তাঁর লিখিত প্রশংসা জ্ঞাপন করেছেন। একথা অবশ্য সাহিত্যপ্রেমী মাত্রেই স্বীকার করবেন, যে কাম্যু ঔপন্যাসিক হিসেবে যতটা ভাল ছিলেন, দার্শনিক হিসেবে ততটা নয়। আবার সাত্রর্ দার্শনিকের ওভারকোটে যেভাবে স্বচ্ছন্দ, ফিকশন লেখক হিসেবে ততটা নন। কিন্তু প্রথম দিকে তাঁরা দু’জনেই দু’জনের লেখা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। দার্শনিক সাত্রর্ কাম্যুর ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’ নিয়ে প্রশংসা করছেন, আবার কাম্যুও সাত্রর্-এর ‘নসিয়া’র গুণকীর্তন করছেন, অথচ খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে গল্পকার সাত্রর্কে নিয়ে কাম্যু পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ নন। আবার ‘মিথ’-এর অগোছালো দর্শন সাত্রর্কে পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। তাঁদের লেখা ও জীবনযাপন পাশাপাশি রেখে দেখাচ্ছেন মার্টিন দেখাচ্ছেন, কীভাবে দু’জনের ভাবনায় মিল ও অমিল দুই-ই উপস্থিত ছিল। কিন্তু তারপর মধুচন্দ্রিমা শেষের দিকে এগোয় ‘নো এগজিট’ নাটকের অভিনয় ও পরিচালনাকে কেন্দ্র করে। “And then, and this Camus must have felt, like gravity weighing upon him, Sartre was controlling Camus. Camus wanted to walk out of the door; he was planning to go... did Sartre guess as much?” ভুলে গেলে চলবে না, কাম্যু ফরাসিতে লিখলেও তিনি ‘ফরাসি’ নন, আলজিরীয়। ফরাসিরা যাকে বলে ‘পিয়ে-নোয়ার’ বা কালো-পা। সেই হিসেবে কাম্যু চিরকালই ফরাসি সমাজে আগন্তুক, ব্রাত্য। তিনিও যেন বেরোতেই চেয়েছিলেন সার্ত্র্-এর ছত্রছায়া থেকে: “And now Sartre had, in his cunning way, managed to anticiapte that move and throw him off... He began to see that there could be drawbacks to directing Sartre’s play: above all, that all along Sartre was directing him. Pulling his strings.”
তবু তারও পর কিছুদিন দু’জনের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। তাঁরা নাত্সিমুক্ত প্যারিসে একসঙ্গে আমোদ করেছিলেন, মাতাল হয়েছিলেন, এমনকী একই মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন দু’জনে। কিন্তু দু’টি আলাদা সত্তার আলাদা ভাবনা ১৯৫২ সালে তাঁদের ‘এবং’ থেকে ‘বনাম’-এ নিয়ে চলে গেল। অ্যাবসার্ড ও এক্সিসটেনশিয়ালিজম-এর সংঘাত, দর্শন ও উপাখ্যানের সংঘাত, প্যারিস ও আলজিরিয়ার সংঘাত: তাঁদের সংঘাত নানা ধরনের হতে পারত। কিন্তু যা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ফাটলটি ধরে তার নাম কমিউনিজম ও তৎজনিত বিপ্লব। হিংসা না হিংসা নয়? সাত্রর্ প্রথমটির পক্ষে। কাম্যু দ্বিতীয়টির। এই নিয়ে ধাপে ধাপে কীভাবে ভাঙল ‘এবং’.... প্রবেশ করল ‘বনাম’, তার সুললিত ধারাবিবরণী দিয়েছেন অ্যান্ডি মার্টিন। বিভিন্ন প্রবন্ধে, চিঠিতে, সমালোচনায়, চাটুকারদের ইন্ধন জোগানোয় গোলকিপার (ফুটবল খেলা কাম্যুর প্যাশন) এবং বক্সার (সাত্রর্ বক্সিং করতেন!) বিশ্বযুদ্ধের পর আত্মগরিমা ও বৌদ্ধিক সত্তার যুদ্ধে নিরত হলেন। এবং ভাঙন ঘটল। জাঁ পল সাত্রর্ এবং আলবেয়ার কাম্যু বন্ধুত্ব রাখলে কী হত, তাঁদের মধ্যে ফাটল সাহিত্য ও দর্শনের কোনও ক্ষতি করল কি না, না কি আখেরে সাহিত্য ও দর্শনের লাভই হল তাতে, সে সব প্রশ্ন থাকবেই। অবশ্য ১৯৬০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় কাম্যুর মৃত্যু একটু দ্রুতই যবনিকাপতন ঘটায় এই প্রশ্নাবলির। অনেক সময় পরস্পরের ছত্রছায়া ক্ষতিই করে স্বাধীন চিন্তাধারার। আবার আর্টের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী প্রাধান্য পেয়েই থাকে। অ্যান্ডি মার্টিনের বইটি সুখপাঠ্য। বইয়ের দু’জন মূল ব্যক্তিত্বকে নিয়ে যাঁদের অনুসন্ধিৎসা আছে, তাঁদের ভাল লাগতে পারে। তবে রোনাল্ড আরনসনের ‘কাম্যু অ্যান্ড সার্ত্র, দ্য স্টোরি অব আ ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড দ্য কোয়ারল দ্যাট এন্ডেড ইট’ বইটি এই একই বিষয় নিয়ে লেখা ও আগেই বিখ্যাত। মার্টিনের বই তার উপর নতুন কিছু যোগ করে না। সর্বোপরি, বইটি ভাব ও ঝগড়ার বিস্তারিত বিবরণ দিলেও, তার ফলে সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে মোদ্দা চাওয়াপাওয়ার হিসেবটি কী দাঁড়ায়, তা নিয়ে কোনও দূরদৃষ্টি দেয় না। বনাম কাম্য না এবং তা নিয়ে মার্টিন নীরব। এই বই বহু উদাহরণ, উদ্ধৃতি, জীবনযাপনের চিত্র ও ভারী সুললিত গদ্যে একটি সময়ের বর্ণনা ছাড়া সাধারণ পাঠককে যা দেয়, তা মোটামুটি একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি তুলে বলা যায়: এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়।

সাত্রর্ ভার্সাস কাম্যু, দ্য বক্সার অ্যান্ড দ্য গোলকিপার, অ্যান্ডি মার্টিন। সাইমন অ্যান্ড শুস্টার


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.