প্রবন্ধ ১...
কোন রাজ্য ‘বিশেষ’, কে বলবে
র্থ কমিশন থেকে রাজ্য দুই খাতে টাকা পায় ট্রান্সফার বা আর্থিক সম্পদের হস্তান্তর এবং গ্রান্ট-ইন-এড বা অনুদান। এই প্রসঙ্গে সংবিধানের ২৭৫তম অনুচ্ছেদটি স্মরণে রাখা যেতে পারে। তাতে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ এই রকম: ‘বিভিন্ন রাজ্যের প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রত্যেক বছর সংসদের অনুমোদন মোতাবেক যে বিশেষ অনুদান (গ্রান্টস ইন এড) দেওয়া হবে, তার সংস্থান করা হবে কনসলিডেটেড ফান্ড অব ইন্ডিয়া থেকে, বিভিন্ন রাজ্যের জন্য বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান স্থির করা হবে। বিভিন্ন রাজ্যে তফসিলি জনজাতির মানুষের সম্মতিসাপেক্ষে বা তফসিলি এলাকার প্রশাসনের মানকে অন্যান্য এলাকার প্রশাসনের মানে উন্নীত করার জন্য যে মূলধনী এবং পুনরাবৃত্ত খরচের প্রয়োজন হবে, তার সংস্থানের জন্য অনুদান দেওয়া যেতে পারে।’
এর অর্থ কী বুঝব? আমি যে রাজ্যেরই বাসিন্দা হই না কেন, ভারতের নাগরিক হিসেবে সম পরিমাণ এবং সম মানের গণ-পণ্য এবং পরিষেবা (পাবলিক গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস) আমার প্রাপ্য। অথচ সব রাজ্যের আর্থিক ক্ষমতা এক নয়। রাজ্যের আর্থিক অসঙ্গতির কারণে নাগরিক যাতে বঞ্চিত না হন, তার জন্যই এই আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র তফসিলি জনজাতি বা তফসিলভুক্ত অঞ্চলের কথা সংবিধানে বলা হয়নি। সংবিধানের ২৭৫তম অনুচ্ছেদটির অর্থ যদি আমি বুঝে থাকি, তবে ভারতের সব রাজ্যের জন্যই আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থাটি প্রযোজ্য।
মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া এবং নীতীশ কুমার। বিশেষ তালিকাভুক্ত
হওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছে বিহার। ছবি: পি টি আই
রাজ্যের আর্থিক ক্ষমতা এবং নাগরিকদের প্রাপ্য সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের মধ্যে যে ফারাক থেকে যায়, আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে তা-ই পূরণ করার কথা। তা কিন্তু কখনও করা হয় না। ফলে, আমার মতে, অনুদান এবং হস্তান্তরিত সম্পদের মধ্যে বারে বারেই গুলিয়ে ফেলা হয়। অর্থ কমিশন যে সম্পদ হস্তান্তর করে, তা নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলে। এক একটি অর্থ কমিশন এক এক ধরনের সূত্র ব্যবহার করেছে। প্রতিটি অর্থ কমিশনই সচেতন থাকতে চায়, যেন আর্থিক সম্পদের হস্তান্তর রাজ্যগুলিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে নিরুৎসাহ না করে। সেই কারণেই হস্তান্তরের সূত্র তৈরি করার সময় তাতে রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ের প্রচেষ্টা, রাজকোষ ঘাটতি কম রাখার উদ্যোগ ইত্যাদি সূচকের দিকে নজর রাখা হয়। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, শুধুমাত্র বিশেষ তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলিই আর্থিক অনুদান পাবে। আর যে সব রাজ্য বিশেষ তালিকাভুক্ত নয়, তাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে শুধুমাত্র হস্তান্তরিত সম্পদ, আর যদি ভাগ্যক্রমে সামান্য অনুদান পাওয়া যায়, সেটুকু।
বিশেষ তালিকা বিষয়টি কী, তা খুব স্পষ্ট নয়। এখন ভারতে যে রাজ্যগুলি এই বিশেষ তালিকাভুক্ত, সেগুলি হল অরুণাচল প্রদেশ, অসম, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, ত্রিপুরা এবং উত্তরাখণ্ড। তবে কি এই রাজ্যগুলি কোনও বিশেষ অর্থে অনগ্রসর? তা তো নয়। অনগ্রসরতার যে মাপকাঠিই ব্যবহার করা হোক না কেন, এই রাজ্যগুলি ছাড়াও দেশে অনগ্রসর রাজ্য রয়েছে। যে রাজ্যগুলি সাধারণ শ্রেণিভুক্ত, সেগুলিতেও অনগ্রসরতার অভাব নেই। বিহার এই বিশেষ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি করতে পারে কি না, তা পৃথক প্রশ্ন। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কোনও রাজ্যকে যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিশেষ তালিকাভুক্ত করা হয়, তা যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ নয়। যোজনা কমিশনের মতে, বিশেষ তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কতগুলি শর্ত পূরণ করতে হবে: রাজ্যটিকে পার্বত্য এবং দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত হতে হবে; জনঘনত্ব কম হতে হবে এবং/ অথবা রাজ্যের জনসংখ্যায় তফসিলি জনজাতিভুক্ত মানুষের অনুপাত যথেষ্ট হতে হবে; প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত হতে হবে; আর্থিক এবং পরিকাঠামোগত ভাবে অনগ্রসর হতে হবে এবং রাজ্যটিকে অধিবাসীদের উন্নয়নে অপারগ হতে হবে। বাস্তবে দেখছি, কোনও রাজ্যকে বিশেষ তালিকাভুক্ত করার সময় এই নির্দেশিকা তেমন ভাবে মানা হয় না। সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ার শর্তটি ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রেই অনগ্রসরতার মাপ বিচার করা হয় না। অর্থাৎ, যে ভাবে বিশেষ তালিকা নির্ধারণ করা হয়, তার মধ্যে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা আছে, যথেচ্ছাচারের সুযোগও আছে। আমার মতে, এই বিশেষ তালিকা অনগ্রসরতার ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা উচিত, এই তালিকার ভিত্তিতেই অনুদান দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে বাদবাকি রাজ্যকে শুধুমাত্র হস্তান্তরিত সম্পদই দেওয়া হবে এবং তাতে অনুদানের কোনও প্রশ্ন থাকবে না। অর্থ কমিশনের ব্যবহৃত সূত্রও প্রাঞ্জল হবে।
অর্থ কমিশন ছাড়াও আছে যোজনা কমিশন। ১৯৭০-এর দশকে অর্থ কমিশনের ভূমিকা অনেক লঘু করে দেওয়া হয়েছিল এবং তার পর থেকেই যোজনা কমিশনের গুরুত্ব অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। যোজনা কমিশনের কোনও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। তা ছাড়া, যোজনাখাতে ব্যয় এবং যোজনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়ের তারতম্যটাও কৃত্রিম। যোজনা কমিশনও দুই ধরনের অনুদান দিয়ে থাকে একটি কমিশনের বিবেচনাসাপেক্ষ, অপরটি বিবেচনানিরপেক্ষ। এই দ্বিতীয় শ্রেণির অনুদানটি ১৯৯১ সাল থেকে গ্যাডগিল-মুখোপাধ্যায় সূত্র মেনে দেওয়া হয়, যদিও এই সূত্রটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। এই অনুদানের ৩০ শতাংশ পায় বিশেষ তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলি। অর্থাৎ আবারও সেই বিশেষ তালিকাভুক্ত বনাম অন্যান্য রাজ্যের দ্বন্দ্বটি এসে পড়ল। বিশেষ তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলি যোজনা কমিশনের বিবেচনানিরপেক্ষ অনুদানের ৯০ শতাংশ পায় সাহায্য হিসেবে, বাকি ১০ শতাংশ ঋণ। যে রাজ্যগুলি বিশেষ তালিকাভুক্ত নয়, তাদের জন্য কমিশনের বিবেচনানিরপেক্ষ অনুদানের খাতে বরাদ্দ অর্থের ৭০ শতাংশ অবশিষ্ট থাকে। রাজ্যগুলি একটি বিশেষ সূত্র মেনে এই অনুদান পায় রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৬০ শতাংশ, রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে ২৫ শতাংশ, রাজ্যের আর্থিক কার্যকলাপের ভিত্তিতে ৭.৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৭.৫ শতাংশ রাজ্যের বিশেষ সমস্যার ভিত্তিতে। এই রাজ্যগুলি কমিশনের থেকে যে অর্থ পায়, তার ৭০ শতাংশ ঋণ এবং ৩০ শতাংশ সাহায্য। এই অঙ্কগুলি কীসের ভিত্তিতে স্থির হল? কোনও যথার্থ উত্তর নেই। যখন গ্যাডগিল-মুখোপাধ্যায় সূত্র প্রথম চালু হয়েছিল, তখন এই ছিল অনুপাত। এখনও সেটাই চলে আসছে। বিশেষ তালিকার অন্তর্ভুক্তি, সাহায্য বনাম ঋণ সবই যুক্তিহীন ভাবে চলছে।
কেন্দ্র এবং রাজ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ, আমার মতে, অর্থ বণ্টনে যথেষ্ট খামখেয়ালিপনা রয়েছে। যোজনা কমিশনের বিবেচনাসাপেক্ষ অনুদানের কথা আলোচনা করলে এই খামখেয়ালিপনা আরও স্পষ্ট হবে। আপাতত জোর দিয়ে বলা দরকার, বিশেষ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির একমাত্র মাপকাঠি হোক অনগ্রসরতা। এবং এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে যোজনাখাতে ব্যয় এবং যোজনাবহির্ভূত খাতে ব্যয়ের কৃত্রিম বিভাজন এ বার বিলুপ্ত হবে। আর্থিক অনুদান আসবে অর্থ কমিশনের মাধ্যমে, যোজনা কমিশনের মাধ্যমে নয়। অনগ্রসরতার ভিত্তিতে নতুন যে তালিকা তৈরি হবে, এই অনুদান শুধুমাত্র সেই তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলিকেই দেওয়া হবে। বাকি রাজ্যের জন্য থাকবে সূত্র-ভিত্তিক হস্তান্তরিত সম্পদ। লেখার গোড়াতেই বলেছিলাম, হস্তান্তরিত সম্পদ এবং অনুদান দুটো সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। সংবিধান তা-ই বলে। বিশেষত সত্তরের দশকে আমরা সংবিধানের অভিপ্রেত উদ্দেশ্যকে লঘু করে দিয়েছি। পুরনো কাঠামোয় ফিরে যাওয়া দরকার।

লেখক অর্থনীতিবিদ, দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর সঙ্গে যুক্ত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.