এসার গোষ্ঠীর প্রকল্প ঘিরে শাসকদলের একাংশের মদতে রাস্তার জমি নিয়ে আন্দোলনে সিঁদুরে মেঘ দেখছে পানাগড় শিল্পতালুক। এসার গোষ্ঠীর প্রকল্প বাধা পেলে সেখানকার প্রায় সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকার লগ্নি ঘিরেও সংশয় তৈরি হবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের সন্দেহ।
বর্ধমানের জাটগোড়িয়ায় এসার অয়েল সংস্থার ‘কোল-বেড-মিথেন’ (সিবিএম) গ্যাস প্রকল্পের সঙ্কট নিয়ে মঙ্গলবার দিনভর চাপানউতোর চলে। যদিও শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে এসার-কর্তারা বিষয়টিকে ‘সামান্য ঘটনা’ বলেই বর্ণনা করেন। বিষয়টি শীঘ্র মিটে যাবে বলেও আশা তাঁদের। কিন্তু যদি তা না হয়, সে ক্ষেত্রে ওই এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
বাম আমল থেকে রাজ্যে সিবিএম উত্তোলনে যুক্ত এসার গোষ্ঠী। কার্যত সেই সূত্রেই এ রাজ্যে পানাগড়ে সার কারখানা গড়তে এসেছিল ম্যাটিক্স-ও। দু’টি লগ্নিই একে অপরের পরিপূরক। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে এসার গোষ্ঠীর সিইও ইফতিকার নাসির জানিয়েছিলেন, দুর্গাপুর মহকুমায় ৩৫০-৫০০টি কুয়ো খোঁড়ার জন্য আরও দু’হাজার কোটি লগ্নি করবেন তাঁরা। এখনও পর্যন্ত ৭০০ কোটিরও বেশি লগ্নি করা হয়েছে। শিল্পমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে এর পরে হলদিয়ায় বেঙ্গল লিড্স-এর শেষ দিনেও এসেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, সিবিএম-এর মতো বিকল্প শক্তিক্ষেত্রে এ রাজ্যের অগ্রণী ভূমিকার কথাও। |
কাঁকসায় মিথেনের কুয়ো। ছবি: বিকাশ মশান। |
একই ভাবে রাজ্যের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পানাগড়ে ম্যাটিক্সের প্রকল্পও। শিল্পমন্ত্রী তাঁদের আমলে লগ্নির কথা বলতে বারবারই ম্যাটিক্সের উদাহরণ দেন। পানাগড়ে তারা দুই পর্যায়ে মোট দশ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করবে। প্রথম পর্যায়ে বছরে ১৩ লক্ষ টন সার তৈরি হবে। দুর্গাপুরে এসারের প্রকল্প নিয়ে সঙ্কট প্রসঙ্গে ম্যাটিক্সের অন্যতম কর্তা কপিল খাণ্ডেলওয়াল এ দিন বলেন, “এটা উদ্বেগের বিষয়। ওই গ্যাসের উপর নির্ভর করেই আমরা এখানে বিপুল লগ্নি করে আন্তর্জাতিক মানের কারখানা গড়ছি।” তিনি জানান, সে জন্যই দু’টি প্রকল্পের কাজ কার্যত একসঙ্গে চলছে। এসারের সিবিএম-এর বেশির ভাগটাই নেবেন তাঁরা। ফলে এসার-এর প্রকল্প পিছিয়ে গেলে সঙ্কটে পড়বে ম্যাটিক্স-ও। আগামী সেপ্টেম্বরে সেটি চালু হওয়ার কথা। তবে তিনিও আশাবাদী, জট দ্রুত কাটবে। দ্বিতীয় কারখানার জন্য অবশ্য তাঁরা অন্য জায়গা থেকে গ্যাস জোগাড় করবেন বলেই আপাতত ঠিক রয়েছে।
ম্যাটিক্স-এর কারখানায় প্রথম পর্যায়েই সব মিলিয়ে কয়েক হাজার কর্মসংস্থান হবে। যোগ্যতার নিরিখে অগ্রাধিকার পাবেন স্থানীয় ও রাজ্যের মানুষই। তবে যেহেতু মূল কারখানায় দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন, তাই সেই যোগ্যতা থাকা জরুরি বলে জানিয়েছেন কপিল। এখনও পর্যন্ত তাঁরা বর্ধমান-সহ রাজ্যের অনেক জেলারই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াকে শিক্ষানবিশ হিসেবে নিয়োগ করেছেন। সিবিএম-এর উপর ভরসা রেখে পানাগড়ে লগ্নি করার কথা ভেবেছে হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গ্লাস-ও। সেখানে ৫-৭ বছরে দুই পর্যায়ে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লগ্নির পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। সংস্থার এক কর্তা জানান, তেলের বিকল্প জ্বালানি হিসেবেই তাঁরা সিবিএম ব্যবহার করতে চান। তাতে ১৫-২০% খরচ বাঁচবে। সস্তায় মিলবে ডিপিএল-এর বিদ্যুৎও।
পানাগড়ে প্রায় ১৪৬০ একর জমিতে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম এই শিল্পতালুক গড়ছে। নিগম সূত্রের খবর, সেখানে আর যারা জমি নিয়েছে তারা হল জনসন, এইচপিসিএল, মারুতি, তাঁতিয়া কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি। তাদের মধ্যেও অনেকেই হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গ্লাসের মতোই উৎপাদন খরচ কমাতে জ্বালানি হিসেবে সিবিএম ব্যবহার করতে আগ্রহী। সে কারণেই, এসার গোষ্ঠীর লগ্নি রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও জঙ্গি আন্দোলনের জেরে রাজ্যের ভাবমূর্তি তলানিতে বলে বারবার অভিযোগ করেছে শিল্পমহল। তাদের দাবি, হলদিয়ার এবিজি-কাণ্ডের পরে সাম্প্রতিক কালে এসার গোষ্ঠীর এই ঘটনা সেই তালিকায় অন্যতম সংযোজন। এক শিল্পকর্তার মতে, রাজ্য সরকার যখন জমি দিতে পারছে না, শিল্পনীতি তৈরি করে উঠতে পারছে না, তখন সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলাটা শিল্পায়নের পক্ষে একান্ত জরুরি। কিন্তু এ ভাবে বারবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ লগ্নিকারীদের মনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েই সংশয় তৈরি করছে। এই সঙ্কট কাটাতে না পারলে রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। |