|
|
|
|
দুর্নীতি নিয়ে বলায় নেতারা খাপ্পা হলেও পাশে দলিত লেখক |
পুরো কথা না বুঝেই বিতর্ক, খেদ আশিসের |
গৌতম চক্রবর্তী • জয়পুর
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
তাঁর মন্তব্যকে ভুল পরিপ্রেক্ষিতে দেখার ফলেই এত বিতর্ক ও বিপত্তি। গোটা বিষয়টি নিয়ে শীঘ্রই বিবৃতি দেবেন সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী। সেইসঙ্গে অভিযোগনামা এবং এফআইআরের বিরুদ্ধে আইনি
পথেই পাল্টা লড়াইয়ের সিদ্ধাম্ত নিয়েছেন তিনি।
জয়পুরের সাহিত্য উৎসব থেকে দিল্লিতে ফিরে আশিসবাবু আজ এ কথা জানান। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই এই বিতর্ক তৈরি করছেন বলে মনে করছেন তিনি। তবে মায়াবতী থেকে রামবিলাস পাসোয়ান দেশের রাজনৈতিক নেতারা যখন বিষয়টি নিয়ে সরব, তখন দলিত লেখক কাঞ্চা ইলাইয়া কিন্তু আজ এগিয়ে এসেছেন আশিসবাবুর সমর্থনে। বলেছেন, তাঁকে দলিতবিরোধী, সংরক্ষণবিরোধী বলে তকমা লাগানোটা ভুল। বাক্যে কিছু অস্পষ্টতা থাকায় এই ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে।
আশিসবাবু আজ বলেন, “আমি যেটা বলতে চেয়েছি তা হল, ধনী এবং উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা দিব্যি নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারেন। ফলে দুর্নীতির কারণে যাঁরা ধরা পড়েন তাঁদের বেশির ভাগই তফসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষ।” তাঁর আরও বক্তব্য, “যখনই কোথাও উন্নয়ন হয় তার সঙ্গে তৈরি হয় দুর্নীতির নানা পথও। দলিত সমাজের মানুষ যদি সেই দুর্নীতির সুযোগ নিতে পারেন তা হলে সেটা তো ভালই। আখেরে তাতে সামাজিক বৈষম্য কমবে।” আশিসবাবুর মতে, দুর্নীতির ফলে যে ‘স্পিড মানি’ আসে তাতে অনেক কাজই দ্রুত হয়। নিম্নবর্গের মানুষের ক্ষমতায়নে তা প্রকারান্তরে সহায়তাই করে। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে শুরু করে আদালতে মামলা লড়ার মতো অনেক কাজই তখন তার কাছে আগের তুলনায় সহজ হয়ে যায়। “এটা আমি একা বলছি না, এর আগে অনেক অর্থনীতিবিদই এই তত্ত্বের সপক্ষে কথা বলেছেন। রাজনীতিবিদরা আমার এই বক্তব্য নিয়ে হইচই করবেন, সেটা তাঁদের পক্ষে মানানসই বলে। আমি কেবল অর্থনীতির ওই তত্ত্বটিকে একটা সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিতে দেখাতে চাইছি।”
মায়াবতী, রামবিলাসের মতো যাঁরা নিজেদের দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেন, তাঁরা আশিসবাবুর বিরুদ্ধে সরব হলেও কাঞ্চা ইলাইয়া কিন্তু আজ নেতাদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। এই দলিত লেখকের কথায়, “আমার তফসিলি জাতি, উপজাতি ও দলিত ভাইবোনদের বলব, তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় এ বার দাঁড়ি টানুন। আশিস নন্দীকে আমি দীর্ঘকাল চিনি, সমাজবিজ্ঞান সংস্থায় তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজও করেছি। তিনি কোনও দিনই দলিত, ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণের বিপক্ষে ছিলেন না। তাঁকে দলিতবিরোধী বা সংরক্ষণবিরোধী বলে তকমা দেওয়াটা ভুল।” সাহিত্য উৎসবে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আনটাচেব্ল গড’ প্রকাশ করতে এসে কথাগুলি বলেন কাঞ্চা ইলাইয়া। হায়দরাবাদের মৌলানা আজাদ জাতীয় উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেন, “আশিস নন্দীর উদ্দেশ্য ভাল, কিন্তু বাক্যটা খারাপ ছিল।” “দলিত, ওবিসি, তফসিলি জাতি ও উপজাতির মধ্যে দুর্নীতি সবচেয়ে প্রবল বলে মনে হয়,....” আশিসের এই বাক্যটিকে না ছিঁড়ে যথাযথ ও সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখার আবেদন জানিয়েছেন কাঞ্চা। তাঁর ব্যাখ্যা, তর্কটা যে ভাবে হচ্ছিল, সেখানে আশিস একটি বাক্য বলেননি। দেশের সম্পদে বরাবরই অধিকার ছিল উচ্চবর্ণ ও উচ্চবর্গের। তাই তারা ঘুষ নিয়েছে, দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছে। তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি সবে সেই সম্পদে অধিকার পেয়েছে। ফলে তারাও একই ভাবে ভাবে ঘুষখোর, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। এই কথাটাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চবর্ণ সংক্রান্ত বাক্যটি পরিষ্কার করে না বলাতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের এই সংঘর্ষ নিয়ে কাঞ্চার চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী আর কে! তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অস্পৃশ্য ঈশ্বর’ প্রকাশের মুখে, গত মাসে হায়দরাবাদের একটি কাগজ মন্তব্য করেছে, এই বই অশান্তি বাধাতে পারে। এটি নিষিদ্ধ করা উচিত। নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি কাঞ্চার ‘হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু’ বা তারও পরে ‘বাফেলো ন্যাশনালিজম’ নিয়ে বর্ণহিন্দু সমাজ একই রকম উত্তাল হয়েছিল।
একান্ত আলাপচারিতায় কাঞ্চা জানালেন, তাঁর বইয়ে পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত ভদ্রলোকের দ্বিচারিতার প্রসঙ্গ রয়েছে। তাঁর উপন্যাসে ‘বাসু’জ ব্রাহ্মিণ সোশালিজম’ নামে একটি অধ্যায় আছে। “জমিদার পরিবারের সন্তান বাসু ভদ্রলোক ও কমিউনিস্ট। ভদ্রলোক কথাটা বাঙালি আবিষ্কার। সেখানে জাতপাত নেই। বদ্যি গুপ্ত, কায়স্থ গুহদের সঙ্গে বারেন্দ্র সান্যাল, কনৌজি বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাহ্ম সমাজের লোকেরাও একসঙ্গে চায়ের আসরে বসেন। তবে লনে বসে চা খাওয়াটুকুই সব। পরস্পরের মধ্যে বিয়ে-শাদি হয় না,” লিখছেন কাঞ্চা।
তিনি মনে করেন, “আশিস সে দিন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ বর্ণের দ্বিচারিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। দ্বিচারিতার কারণেই পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকেরা তাঁদের রাজনীতিতে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, দলিতদের স্বীকার করেন না। আর ওই ভাবেই নিজেদের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখেন।” |
|
|
|
|
|