|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
জাতীয় দলের চিন্তা এখনই নয়
কঠোর নেট অনুশীলনের পর বাড়িতে ফিরে পড়াশোনা করেন।
অনূর্ধ্ব উনিশ জাতীয় দলের বিশ্বকাপ জয়ও তাঁরই অধিনায়কত্বে। তবু পা এখনও
মাটিতেই। সেই উন্মুক্ত চন্দকে নিয়ে দিল্লি থেকে লিখছেন চেতন নারুলা |
দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র উন্মুক্ত চন্দ। এই বয়সের যে কোনও ছেলে-মেয়ের পক্ষেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলো জীবনের সেরা অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে। এখানে ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতির মূল কারণটা আসলে শুধুই পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্রটুকু জোগাড় করা। তবে উন্মুক্তের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। সে অনূর্ধ্ব উনিশ ভারতীয় ক্রিকেট দলের একজন সদস্য। অস্ট্রেলিয়াতে দেশের হয়ে চার-চারটে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছে। যার মধ্যে যুব বিশ্বকাপও রয়েছে। তবে এই সবের মধ্যে তার আর কলেজে প্রয়োজনীয় ‘উপস্থিতি’টুকু পাওয়া হয়ে ওঠেনি!
শেষ কবে একজন পড়ুয়ার পরীক্ষায় বসা নিয়ে মানুষের মধ্যে এই পরিমাণ শোরগোল উঠেছিল মনে করা সত্যিই কঠিন! তবে হ্যাঁ, এই ঘটনাটি অবশ্যই আর পাঁচটা ঘটনার থেকে অনেকটাই আলাদা। তবে ও নিজের লড়াইটা চালিয়ে যায়। আর শেষ পর্যন্ত কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে পরবর্তী বর্ষের পড়াশুনোও করছে। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে উন্মুক্ত জানালেন, “আমি কখনই এটা বলিনি যে আমাকে পাশ করিয়ে দিতে হবে। শুধু পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়েছিলাম। তার পর আমি পড়াশুনো করে পরীক্ষা দিয়ে সফল হই।”
এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই ঘটনাটাও ওর জন্য একটু অন্য রকম পরীক্ষাই বলা যায়। পর পর অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপে সাফল্য, ফাইনালে শতরান এবং তার সঙ্গে আবার রান তাড়া করে রুদ্ধশ্বাস জয়সব মিলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া। বিশেষজ্ঞরাও যাকে লম্বা রেসের ঘোড়া বলে শংসাপত্র দিয়ে দিয়েছেন, তার পক্ষে আকাশে ওড়াটা খুব একটা আশ্চর্যের হত না তা বলাই বাহুল্য। তবে উন্মুুক্তের ক্ষেত্রে কিন্তু তা একেবারেই হয়নি।
“আমার মতে মাথা ঠান্ডা রাখাটা খুব দরকার। আর সেটা শুধু ক্রিকেট মাঠের মধ্যেই নয়, বাইরেও,” বললেন তিনি। “কথা বলার সময় একটু ভেবে বলাটাই ভাল। যা ভাবছি সব সময় তার পুরোটাই তো আর বলা যায় না! শতরানের পর মিডিয়া আমাকে রাতারাতি নায়ক বানিয়ে দিয়েছিল। তবে আমি এই চ্যালেঞ্জটা নিতে ভালবাসি। দলের প্রয়োজনে নিজের সেরা খেলাটা খেলতে পারলে একটা অন্য রকম আনন্দ হয়।” |
|
কিন্তু এই সব কিছুর মাঝে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা হল মাথা ঠান্ডা রেখে পারিপার্শ্বিকের পরিস্থিতি থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। টি-২০ হোক বা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, স্কোর বোর্ডের রানের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল চার পাশ থেকে যতটা সম্ভব শেখার চেষ্টা করে যাওয়া। উন্মুক্তও বোধহয় সেটাই করছে। “আম্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা শুরু করার জন্য কোনও বাঁধা ধরা সময় হয় না। তবে সত্যি বলতে কী, জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে এখনই এতটা চিন্তা করতে চাইছি না,” উন্মুক্ত বললেন। আরও জানালেন, “আপাতত আমি যত বেশি সম্ভব ক্রিকেটটা খেলে যেতে চাই। সেটা আমার স্কিল ভাল করতেও সাহায্য করবে। তা ছাড়া আমার কোচের সঙ্গে যখন খেলা নিয়ে আলোচনা করি, জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে কোনও কথা হয় না। বরঞ্চ উনি আমাকে নিজের খেলার ভাল-মন্দ দিকগুলোর দিকে নজর দিতে বলেছেন। কী ভাবে ভাল দিকগুলোকে আরও শক্তিশালী করা যায় আর দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে ওঠা যায় আপাতত সেই দিকেই নজর দিতে চাই।”
সব চেয়ে কঠিন যে প্রশ্নটার মুখোমুখি এখন ভারতের তরুণ প্রজন্মের ক্রিকেটাররা, সেটা হল কী উপায়ে বিভিন্ন ধরনের ফরম্যাটের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। লিমিটেড ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ আর লম্বা ওভারের ইনিংস খেলার জন্য নিজের মানসিকতাকে ঠিকঠাক ভাবে তৈরি করাটা সত্যিই ভীষণ কঠিন কাজ। বেশির ভাগ ক্রিকেটারই এই কৌশলটা জানেন না। আর অনেকেরই ধৈর্য খুব কম আর এই স্টাইলগুলো সঠিক ভাবে প্রয়োগ করার পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত নন। দিল্লি টিমের ওপেনার যদিও এই সব বিষয় নিয়ে এতটুকুও চিন্তিত নন। তিনি মনে মনে নিজস্ব একটা উপায় ঠিকই বের করে রেখেছেন। “আমার তো মনে হয় না ফরম্যাটের খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখন আমরা এত ক্রিকেট খেলি যে এক এক সময় মনে হয় তা প্রয়োজনাতিরিক্ত,” বললেন তিনি। তিনি আবারও বললেন, “টি-২০ হোক বা ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট, একজন স্পিনারকে খেলার পদ্ধতিটা কিন্তু দুই জায়গাতেই এক। একজন বোলার যদি আমায় একটা ফুল পিচ বল করে, তা হলে আমি তো ওকে কভারের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করব। আমার চিন্তা এখন এ ভাবেই প্রোগ্রামড হয়ে থাকে। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর যত দূর সম্ভব ভুলগুলো শুধরে নেওয়া।”
এই বক্তব্য থেকে যেটা পরিষ্কার বোঝা যায় তা হল, এখানে এমন একজন তরুণ ক্রিকেটারের কথা আমরা বলছি, যে নিজের খেলাটা খুব ভাল বোঝে। বা বলা যায় ভাল করে বুঝতে শুরু করেছে। অনেক অল্পবয়েসি ক্রিকেটারের ব্যাপারে কিন্তু এটা এত জোর দিয়ে বলা যাবে না। বিশেষত যখন আই পি এল, আর না জানি কত রকমের ব্যাপার রয়েছে এদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করানোর জন্য। এই রকম একটা সিচুয়েশনে ১৯ বছরের এই ছেলেটির মগজ এত ঠান্ডা কী ভাবে? “আমার পরিবারের জন্যই আমার পা সব সময় মাটিতে থাকে”, বলেন তিনি। “আমার আশেপাশে অনেক সঠিক মানুষ রয়েছেন যাঁদের জন্যই আমি নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পেরেছি। নইলে খেলা থেকে কবেই সরে যেতাম। আমার একটা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুবৃত্ত আছে যাদের সঙ্গেই আমি সময় কাটাই। খেলা না থাকলে খুব একটা বেরোইও না। পার্টিতেও যাই না বেশি।”
ওঁর এই বক্তব্যে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে। কলেজ, পড়াশোনা যদিও আগে আসে, প্র্যাকটিসটা কিন্তু তিনি আরও বেশি মন দিয়ে করেন। অ্যাকাডেমিতে কঠোর নেট অনুশীলনের পর, বাড়ি ফিরে তিনি পড়াশোনা করেন রোজ। সকালের খবরের কাগজ রোজ তাঁর পড়া চাই। আর দাবিও করলেন যে ‘টাইমস নাও’ চ্যানেলে ‘নিউজআওয়ার’ দেখাটা তাঁর রোজের নেশা।
স্ট্যাটিসটিকস দেখতে গেলে এ বারের ‘রঞ্জি সিজন’-টাই তাঁর এখনও অবধি নেওয়া তিনটে’র মধ্যে সব চাইতে সেরা প্রচেষ্টা। দিল্লির হয়ে রোজ ওপেনিং করার সুযোগটাও পেয়েছেন এবং তার পরিপূর্ণ ব্যবহারও করছেন।
২০১২-১৩ সিজনের আটটা ম্যাচের মধ্যে ৩৭.০৮ গড়ে করেছেন ৪৪৫ রান। সঙ্গে করেছেন একটা শতরান আর তিরিশটা অর্ধ শতরান। এই ঘটনা থেকে দুটো জিনিস লক্ষ করার মতো। একটা হল, পণ্ডিতদের নানান মতামত থাকলেও এখনও তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তৈরি নন। আর দ্বিতীয়টা হল, গত দুই সিজনের সঙ্গে তুলনায় এই সিজনটা তাঁকে প্রচুর সম্ভাবনার সঙ্গে অনেকটাই এগিয়ে রাখল। “উন্মুক্তের সব চেয়ে ভাল ব্যাপারটা হল এই যে, ও সব সময়ই নিজের খেলার খুঁটিনাটি দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করে,” বললেন সঞ্জয় ভরদ্বাজ। উন্মুক্তের কোচ। “ঘরের মাটিতে হোক বা বাইরে, ভাল খেলুক বা না খেলুক, ও ওর খেলা নিয়ে কথা বলতে সর্বদাই রাজি। আর এটাই প্রমাণ করে একজন ভাল ক্রিকেটার হিসেবে কত দূর যেতে চায় ও। ইচ্ছেটাই তো আসল। আর সেটা পুরো মাত্রায় রয়েছে ওর।”
এর পরেই সেই অবধারিত প্রশ্নটা এল।
উন্মুক্ত কি তা হলে ‘বিগ লিগ’-এ যেতে পারবেন? পারবেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘জেনারেশন ওয়াই’-কে সামনে নিয়ে আসতে? ‘‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই”, বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর দিলেন উন্মুক্তের কোচ। আত্মবিশ্বাস তাঁর গলায়। “বলতে পারেন, আমি একজন মালি। এইটুকু আশ্বস্ত করতে পারি, এই বীজ থেকে যে মহীরুহটা তৈরি হবে সে একটা সময় খুব ভাল ফল দেবে।” |
|
|
|
|
|