|
|
|
|
কিউবিকলে রাজনীতি
সারাটা দিন গুটিয়ে থাকা। মান-সম্মান ধুলোয় লুটোপুটি। অফিস পলিটিক্স
সামলানোর উপায়টা তা হলে কী? জানাচ্ছেন রুমি গঙ্গোপাধ্যায় |
চাকরির বয়স মাত্র আট মাস। এর মধ্যেই স্নেহা কেমন বদলে গেছে। কথাই বলতে চায় না। গুমরে থাকে। কিছু বলতে গেলেই মেজাজ দেখায়। রোজগার করছে বলেই কি এতটা পরিবর্তন? বুঝতে পারেন না সুদেষ্ণা। স্নেহার মা। মেয়ের এই ব্যবহার মানতেও পারেন না। বাড়ি ফিরেই স্নেহা নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলে। ভরসন্ধেতেই ঘুমিয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে মনোবিদের দ্বারস্থ হন সুদেষ্ণা। জানা যায়, স্নেহা গভীর অবসাদে ভুগছে।
কাজ নয়, অফিসে গুটিকয়েক সহকর্মীর দুর্ব্যবহার স্নেহাকে চাপে রাখে। মোটা মাইনের ভাল চাকরি আর অন্য দিকে কয়েক জনের কাছে নাকানিচোবানি দু’য়ের মাঝে সে বিপর্যস্ত। চাকরিটাই ছেড়ে দেবে? সেটা তো চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার শামিল! ও দিকে সহকর্মীদের রীতিমতো র্যাগিং। দিশেহারা স্নেহা। ফলাফল মন খারাপ, কোনও কিছু ভাল না লাগা।
চেনাচেনা লাগছে? স্নেহার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছেন? ও, আপনার সমস্যা তো বসকে নিয়ে। ভয়েই জবুথবু। সারাটা দিন গুটিয়ে থাকেন। এই বুঝি ঝাড়ল। মান-সম্মান ধুলোয় লুটোপুটি। অফিসে অনেকেই ব্যাপারটাকে আমল দেয় না। কিন্তু আপনি ঠিক মানতে পারেন না।
খিটখিটে, রগচটা, ধ্যাতানি ‘বস’ বললেই এই শব্দগুলি মাথায় ভিড় করে। কিন্তু এই শহরের এক বস জানাচ্ছেন একেবারে উল্টো কথা। বয়স ছাব্বিশ। সমবয়সি কেউ কেউ থাকলেও অধস্তনদের অধিকাংশই বেশি বয়সি। ‘‘কিছু দিনের মধ্যেই বুঝলাম, মাথার ওপর বয়সে ছোট কাউকে এঁরা সহজ ভাবে নিতে চাইছেন না। যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। কখন কোন বিপাকে ফেলে,’’ বললেন বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত সৌমেন অধিকারী। |
|
মোদ্দা কথা, ঝুটঝামেলা ছাড়া মোম-মসৃণ ভাবে কাজ সেরে সোনামুখ করে বাড়ি ফিরবেন এ যেন সোনার পাথরবাটি। সোজা বাংলায় ‘অফিস পলিটিক্স’। ফ্রেশারই হোন বা বহু বছরের অভিজ্ঞ কর্মী ভুক্তভোগী যে কেউই হতে পারেন।
এই প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন, তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত অর্ক ভট্টাচার্য। ‘‘অফিস যে আর পাঁচটা জায়গার মতো নয়, সেটা প্রথমেই মগজের হার্ডডিস্কে ঢোকাতে হবে। প্রথমে ঠিকঠাক চলছিল। দু’-চার জন ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। পরে মালুম হল, অনেকেই সুযোগ খোঁজে। হ্যান্ডেল করতে না জানলেই মুশকিল।’’
কী ধরনের মুশকিল?
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, চাপ থেকে হতাশা বাড়তে বাড়তে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। চিকিৎসার ভাষায়, সাইকোসোমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার। লিস্টে রয়েছে, প্রেসার, শুগার থেকে শুরু করে পেপটিক আলসার, গ্যাসট্রিক আলসারের মতো তাবড় সব রোগব্যাধি। ক্রমাগত টেনশন থেকে কার্ডিয়োভাসকুলার ডিসঅর্ডার। তাই হতাশায় ডোবার আগেই নড়েচড়ে বসুন। মনঃসমীক্ষক নীলাঞ্জনা স্যানাল জানাচ্ছেন, ‘‘মানিয়ে নিতে না পারলে বুঝতে হবে, আপনার ব্যক্তিত্বে কোনও সমস্যা রয়েছে অথবা কাজে কোনও ত্রুটি আছে। তাই প্রথমে আত্মসমীক্ষা করে বুঝতে হবে সমস্যাটা ঠিক কোথায়।’’
ব্যক্তিত্বের সমস্যা হলে, মনঃসমীক্ষকের সাহায্য নিতে হবে। বাড়িতে সমস্যা থাকলে তার প্রভাবও অফিসে পড়ে। সেই সঙ্গে বুঝতে হবে, কতখানি কাজের চাপ আপনি নিতে পারছেন। কাজের ক্ষেত্র মনোমতো না হলে, মনের ভেতর পুষে না রেখে বসকে জানান। তবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা উগ্র ভাবে নয়। ঊর্ধ্বতন আধিকারিককে তাঁর সম্মান দিয়ে নিজের অসুবিধের কথাগুলো বলুন।
বসকে সামলান
দেখলেই ভয় করে। কিছু বললেই থতমত খাই। এ রকম হলে প্রথমেই বসের দিকটা বোঝার চেষ্টা করুন। তাঁর ওপরও উপর মহলের চাপ রয়েছে। সেটাই অধস্তনদের মধ্যে বিতরণ করে দিচ্ছেন। সমস্যা শুধুই আপনার হলে অন্য দিকগুলো ভাবতে হবে। বাড়িতে বাবা-জ্যাঠার মতো কোনও ডমিনেন্ট-রাগী চরিত্র থাকলেও এ রকম হয়ে থাকে। বসকেও তাঁদের মতো ভেবে নিয়ে কোনও ভাবেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় না। অথবা হয়তো বসের স্বভাবটাই খিটখিটে। সে ক্ষেত্রে তিনি কী বললেন, সেটাকে ব্যক্তিগত ভাবে না নিয়ে মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন, জানাচ্ছেন নীলাঞ্জনা।
বাড়ান নিজের দক্ষতা
“সবার আগে দরকার নিজের কাজের দক্ষতা বাড়ানো,’’ বললেন ডা অমিতাভ মুখোপাধ্যায়। আত্মবিশ্বাস ষোলোআনা বজায় থাকলে অনেক কিছুই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়। একই কথা বললেন বিখ্যাত বেসরকারি সংস্থার ফিনান্স এক্সিকিউটিভ সুতপা চট্টোপাধ্যায়। ‘‘অনেককে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়। তবে নিজেকে তৈরি রাখি। অসুবিধের মুখোমুখি হলে যাতে কাজটা নিজে নিজেই সামলাতে পারি।’’ তাই কাজের ত্রুটি বুঝলে উন্নতির চেষ্টা করুন।
সহকর্মীদের ষড়যন্ত্র
অফিসে কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা দুর্বলদের সঙ্গে মস্করা করে মজা পান। সে ক্ষেত্রেও দরকার আত্মসমীক্ষা। খুঁজে বের করুন নিজের চলাফেরা বা কথাবার্তায় এমন কী আছে, যা অন্যের হাসির খোরাক হচ্ছে। তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। ইচ্ছে না করলেও সহকর্মীদের সঙ্গে মিশতে হবে। কোনও ব্যাপারে টুকটাক কথা বলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করুন, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। নিজের দুর্বলতা বুঝতে দেবেন না।
এমন হতে পারে আপনার কাজ যথেষ্ট ভাল। হিংসার বশবর্তী হয়েই সহকর্মীরা এমন করছেন। সে ক্ষেত্রে তো আপনি জানেনই যে আপনার কাজে কোনও ত্রুটি নেই। ফলে হীনমন্যতা আসার কথা নয়। আপনি আপনার জায়গায় ঠিকই আছেন। তবে পুরোটাই যদি ইচ্ছাকৃত হয় এবং মাত্রা ছাড়ায়, সরাসরি কথা বলুন। ওঁদের জানান, আপনি চাপ অনুভব করছেন। ধীরে সুস্থে কথা বলবেন। সে রকম বুঝলে অফিসে সিনিয়র কোনও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিকে ঘটনাটি জানিয়ে রাখলে ভাল হয়।
তৈরি রাখুন নিজেকেও
সমস্যা সর্বত্রই। কতখানি ঘায়েল করবে, তা আপনার মানসিক গঠনের ওপর নির্ভর করছে। নিজেকে বোঝান জায়গাটা কর্মক্ষেত্র, চাপা প্রতিযোগিতা থাকবেই। তাই প্রকৃত বন্ধু কমই মিলবে। তবে সবাই ক্ষতিকারক নয়। আসলে কোনওটাই নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা নয়। সাদা-কালোর মাপকাঠিতে কিছুই ধরা পড়বে না। বরং খোলা মনে ভাবুন।
|
হতাশার কবলে |
সমাধান: নিজের কাছেই |
• অফিস যেতে ইচ্ছে না করা।
• গেলেই মন খারাপ।
• প্রতিটি মুহূর্তে চাপা আতঙ্ক।
• অমনোযোগী হয়ে পড়া। জানা কাজ ভুল করা।
• অফিস থেকে বেরোলে, সে দিনের মতো
খানিক
স্বস্তি। পর দিন সকাল থেকে
আবার মন খারাপ।
• বাড়ি ফিরলে রাজ্যের ক্লান্তি ঘিরে ধরা। |
• অন্যের ব্যবহারে মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজে মন দিন।
• বেরিয়ে এসে অফিসের কথা না ভাবা অভ্যাস করুন।
• বাড়ি ফিরে গান শুনে, বই পড়ে বা পছন্দের কিছু করে
নিজেকে রিল্যাক্স রাখার চেষ্টা করুন।
• দুশ্চিন্তা মনের ভেতর পুষে রাখবেন না।
ঘনিষ্ঠ কারও কাছে মন খোলসা করুন।
• নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে নিজেকে বোঝান,
আপনি অনেক ভাল আছেন। এর থেকেও খারাপ
পরিস্থিতিতে আপনাকে পড়তে হতে পারে। |
|
|
|
|
|
|