ইয়ার লাপিদ এক বৎসর আগে পর্যন্ত ছিলেন ইজরায়েলের খ্যাতনামা টেলিভিশন-সাংবাদিক, তাঁহার বিশেষত্ব ছিল সে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক মাথাব্যথাগুলিকে লইয়া আলোচনা ও বিশ্লেষণ। বৎসরকাল আগে অকস্মাৎ ঘোষণা, নূতন একটি রাজনৈতিক দল নির্মাণ করিতে চাহেন বলিয়া সাংবাদিকতা হইতে তিনি অবসর গ্রহণ করিতেছেন। সামনেই জাতীয় নির্বাচন। অনেকেই তখন তাঁহার নূতন দল উদ্ভাবনার লগ্ন-নির্বাচনের সমালোচনা করিয়াছিলেন। প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষাও বলিয়াছিল, তাঁহার দল ভাল করিবে না। বুধবার ইজরায়েলের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, সকল সমালোচক ও সমীক্ষকের মুখে ছাই দিয়া লাপিদের শিশু দল ‘ইয়েশ আতিদ’ (যাহার অর্থ, ‘ভবিষ্যৎ বিষয়ে হাল ছাড়িয়ো না’) বিপ্লব ঘটাইয়াছে, দক্ষিণপন্থীদের আসন পূর্বাপেক্ষা সিকি শতাংশ কমাইয়া ১৯টি আসন নিজের দখলে আনিয়াছে, অন্যান্য বামভাবাপন্ন দলগুলির হিসাব মিলাইলে প্রায় ৩৫টি আসন পকেটে পুরিয়াছে। বিপরীতে প্রেসিডেন্ট বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ১২০টির মধ্যে নিজের দলের জন্য ২০টি আসন, এবং তাঁহার সহযোগী দক্ষিণপন্থী নেতা লিবারমানের দলের সঙ্গে মিলাইয়া ৩১টি আসন লইয়া দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। যদি তিনি এখনও প্রেসিডেন্ট পদটি ধরিয়া রাখিতে চাহেন, অন্যান্য বাম, মধ্য-বাম দল ও শিবিরের সহিত সমঝোতায় আসিয়া তাঁহাকে শরিকি সরকার গড়িতে হইবে, অন্য পথ নাই। ইহা এক বিরাট পরিবর্তন। ইজরায়েলের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীরা যে ভাবে কড়া মুষ্টিতে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করিতেছিলেন, তাহার পর নিঃশব্দে নির্ঝঞ্ঝাটে এত বড় পরিবর্তন যে ঘটিতে পারে, লাপিদ যে একা হাতে এত দ্রুত ইজরায়েলের পরিবর্তনশীল জনমতের রাশটি ধরিয়া ফেলিতে পারেন, কেহ ভাবিতে পারেন নাই। ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যমে সেই বিস্ময়ের ছায়া স্পষ্ট, এমনকী হাঁপ ছাড়িবার ইঙ্গিতও অস্পষ্ট নহে।
স্বভাবতই নেতানিয়াহু ও লিবারমানকে এখন সুর পাল্টাইতে হইবে। যে চড়া পর্দায় নিজেদের অ্যাজেন্ডার তারটি বাঁধিয়াছেন, তাহা নামাইতে হইবে। লাপিদের মধ্য-বাম দলটি ইউরোপীয় বাম দলগুলি অপেক্ষা কিছুটা দক্ষিণবর্তী হইলেও ইজরায়েলের প্রেক্ষিতে তাঁহাদের প্রায় বিপ্লবী বলা চলে! তাঁহারা দেশের রাজনৈতিক পদ্ধতির সংস্কার চাহেন, রাজনৈতিক দুর্নীতির লাঘব চাহেন, মধ্যবিত্ত চাকুরে ও ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী শ্রেণির জন্য বিবিধ অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা চাহেন। এক কথায়, তাঁহারা উচ্চমার্গীয় ইজরায়েলি রাজনীতির পরিমণ্ডলে মধ্য-ইজরায়েলের বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর। এই স্বরকে জায়গা দিতে নেতানিয়াহুকে এ বার দ্রুত অনেকখানি নমনীয় ও মধ্যপন্থী হইতে হইবে। বিদেশনীতি লইয়া অবশ্য লাপিদের অবস্থান স্পষ্ট নয়, সমানেই তিনি পাশ কাটাইয়া যান। তবে মনে হয় প্যালেস্তাইনের ক্ষেত্রে শান্তিপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং ইরানের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিতে কোনও পরিবর্তন না ঘটাইবার চেষ্টাই লাপিদের নীতি। প্যালেস্তাইনের ক্ষেত্রে শান্তি চাহিলেও লাপিদ কোনও ভাবেই জেরুজালেমের দ্বিভাজন কিংবা সহ-অধিকার সমর্থন করেন না। তাই প্যালেস্তাইনের সহিত সমঝোতার সম্ভাব্য পথ বিষয়ে তিনি কী ভাবেন জানা নাই। সুতরাং ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আক্রমণাত্মক রক্ষণশীলতা কমিলেও বিদেশনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের আশা ক্ষীণ। বৃহত্তর বিশ্বের উল্লাসের কারণ নাই।
তবে কিনা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রক্ষণশীলতা কমিলে ক্রমে বিদেশনীতিতেও তাহার ছায়া পড়িবার কথা। হয়তো সেই ছায়া এখনও সুদূর। তবু এই নির্বাচন বুঝাইয়া দেয়, ইজরায়েলের মধ্যে আছে আর এক ইজরায়েল, সরকারি মতাদর্শের চাপে পিষ্ট হইয়া যাহার কথা সাধারণত বহির্বিশ্বের অশ্রুত থাকে। অশ্রুতকে শ্রুত করিয়া তুলিবার এই জাদু গণতন্ত্রেরই অমূল্য দান। পশ্চিম এশিয়ার ধূসর বর্তমান ও ধূসরতর ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতে, ইজরায়েলি রাষ্ট্রের যুযুধান নীতির গ্লানিময় প্রেক্ষিতে এই বিপুল পরিবর্তন দেখিয়া গণতন্ত্র ও সভ্যতায় বিশ্বাস ফিরিয়া আসে। ইয়ার লাপিদ এইটুকুর জন্যই অভিনন্দনযোগ্য। |