|
|
|
|
বর্মার রিপোর্ট স্বাগত মুখেই, বাস্তবে সংশয়ী সব দল
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
একেবারে ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুড়েছেন দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস বর্মা।
ধর্ষণের শাস্তি কড়া করতে আইন সংশোধন হবে ঠিকই। কিন্তু আইন সংশোধনের ভার যাঁদের হাতে, নারী নির্যাতন রুখতে সেই রাজনীতিকদের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি বর্মা। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনে অভিযুক্তদের কেন রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে প্রার্থী করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বর্মা কমিটি এই সব ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে। কমিটির দাওয়াই, কারও বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধের অভিযোগ উঠলে দোষী সাব্যস্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। চার্জশিট পেশ বা আদালতে মামলা গৃহীত হলেই ভোটে প্রার্থী হওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হোক। দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তির পর ছয় বছর পর্যন্ত ভোটে লড়ার নিষেধাজ্ঞা বজায় থাক। এ জন্য তিনি জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনের সুপারিশও করেছেন।
প্রকাশ্যে সব রাজনৈতিক দলই বর্মা কমিটির এই সুপারিশকে নীতিগত ভাবে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা এ কথাও স্বীকার করছেন, বাস্তবে এই সুপারিশ মেনে চলা সম্ভব নয়। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও স্থানীয় স্তরে জনপ্রিয়তা বা জাতপাতের সমীকরণ দেখে তাঁকে টিকিট দিতে হয়। না হলে নিশ্চিত আসনও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। গত লোকসভা নির্বাচনেই এমন ছ’জনকে প্রার্থী করা হয়েছিল, যাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় তাঁরা নিজেরাই হলফনামায় এ কথা জানিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে দু’জন জিতে লোকসভায় এসেছেন। আরও ৩৪ জন জানিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অন্যান্য অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের এই কাণ্ডকারখানা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বর্মা কমিটি। দিল্লির ঘটনার পরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা যে ধরনের লিঙ্গবৈষম্য-মূলক মন্তব্য করেছেন, কমিটি তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্যের জন্য আনিসুর রহমান বিচারপতি বর্মার কোপে পড়েছেন। ধর্মীয় গুরু আসারাম বাপুর মতো অনেকে আবার ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকেও দায়ী করেছিলেন। সে সব কথাও ক্ষোভের সঙ্গে উল্লেখ করেছে কমিটি।
বিষয়টি যে যথেষ্ট স্পর্শকাতর, তা সকলেরই জানা। তাই কংগ্রেস, বিজেপি, বাম থেকে শুরু করে আঞ্চলিক দলগুলিও মুখে বর্মা কমিটির সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছে। কংগ্রেস বলছে, সরকার রিপোর্ট খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে। যৌন নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনের কথা বলে নিজের সীমা ছাড়িয়েছে কমিটি এমনটা ঘরোয়া ভাবে বললেও প্রকাশ্যে কেউ সে কথা বলছেন না। বরং সব দলকেই মানতে হচ্ছে, এই বিষয়গুলিও যৌন নির্যাতন বা লিঙ্গবৈষম্যের সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে জড়িত।
তা হলে কমিটির রিপোর্ট মানতে অসুবিধা কোথায়? বিজেপির এক নেতার যুক্তি, “একটা বিপদ হল অনেক সময়ই ভোটের আগে নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ ওঠে। যৌন নির্যাতনের অভিযোগ যার মধ্যে অন্যতম। কারণ এতে ভোটারদের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রতিক্রিয়া হয়। তাই যত ক্ষণ না কেউ দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন, তত ক্ষণ ভোটে লড়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত নয়।” তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় আবার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন যে, মিথ্যে অভিযোগের ক্ষেত্রে বর্মা কমিটি রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রেখেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, আদালতে মামলা গৃহীত হলে তবেই ভোটে লড়ার নিষেধাজ্ঞা থাকবে। বিচারপতি বর্মার যুক্তি, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আদালত যখন মনে করছে, কোনও মামলা শুনানির জন্য গ্রহণ করা যেতে পারে, সেটাই যথেষ্ট। সৌগতবাবু বলেন, “বর্মা দেশের অন্যতম সেরা প্রধান বিচারপতি। আমি ওঁর সুপারিশকে পুরোপুরি সমর্থন করছি।” কমিটির রিপোর্ট অবশ্য বলছে, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের এক প্রার্থীর বিরুদ্ধেও মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ ছিল।
বর্মা কমিটির রিপোর্টের প্রশংসা করে সিপিএম পলিটব্যুরোর দাবি, সুপারিশ খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন মন্ত্রকের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠন হোক। সময় নষ্ট না করে দ্রুত পদক্ষেপ করুক সরকার। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “কমিটির সব সুপারিশ সরকার মানতে বাধ্য নয়। কাজেই সরকার কতটা গ্রহণ করছে, কী প্রস্তাব আনছে তা দেখতে হবে। সেই অনুযায়ী সংসদে আমরা আমাদের মতামত জানাব।” সূত্রের খবর, বর্মা কমিটির রিপোর্টকে প্রাথমিক ভাবে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হবে। বেঙ্কাইয়া নায়ডুর নেতৃত্বাধীন স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে ফৌজদারি বিধি সংশোধনী বিল, ২০১২-র খসড়া জমা রয়েছে।
|
সাবালকত্বের বয়ঃসীমা কমানোর পক্ষে ভগবতী
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা লিঙ্গচ্ছেদ কোনওটাতেই সায় নেই বর্মা কমিটির। কিন্তু বৃহস্পতিবার কলকাতার এক আলোচনাসভায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ জানালেন, তাঁরা চান এমন কিছু, যাতে শাস্তির কথা কল্পনা করেই অপরাধের আগে আতঙ্কে শিউরে উঠবে যে কেউ। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দিল্লির ঘটনা মানুষকে প্রতিবাদের পথ দেখিয়েছে। কিন্তু বর্মা কমিটির রিপোর্ট উল্টো পথে হাঁটছে।” তাঁর মতে, সংশোধনাগারে রেখে বেশির ভাগ অপরাধীরই সংশোধন ঘটে না। “ফাঁসি বা নির্বীজকরণ যদি না-ই করা যায়, তা হলে অন্তত ধর্মের ষাঁড়ের মতো ধর্ষককে দাগিয়ে দেওয়া হোক। যাতে সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পেলেও মানুষ তাকে চিনে নিতে পারে।” কমবয়সীরা যে ভাবে ক্রমশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে সাবালক হওয়ার বয়ঃসীমা আরও কমিয়ে আনার পক্ষেও সওয়াল করেন তিনি। রাজ্য মহিলা কমিশনের সভানেত্রী সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “ধর্ষণ আর ধর্ষণের চেষ্টার মধ্যে যে আইনের ফারাক, তা কমানো দরকার।” বর্মা কমিটি পুলিশ-প্রশাসনের মানসিকতা পরিবর্তনের উপরে অনেকটা জোর দিয়েছে। কিন্তু তা কী ভাবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিগ্ধ শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল। রাজনীতিবিদ মহম্মদ সেলিম বা তপন শিকদারের সামনেই তিনি বলেন, “ধর্ষণের ঘটনার পরে বহু সময়ে সিআইডি তদন্তের দাবি হয়। তাতে কী হবে? পুলিশ এতটাই প্রভাবিত যে তারা অপরাধীকে ধরার বদলে প্রমাণ লোপের চেষ্টা করে।” |
|
|
|
|
|