|
|
|
|
রাজনাথ এলেও নজরে মোদীই |
নিরুপায় হয়েই সঙ্ঘ সরালো গডকড়ীকে |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
বেশ কিছু দিন আগে একান্ত আলাপচারিতায় এক শীর্ষ আরএসএস নেতা বলেছিলেন, “নিতিন গডকড়ী আর নরেন্দ্র মোদী, দু’জনেই আমাদের কারখানায় তৈরি। কিন্তু একই কারখানায় তৈরি হলেও কোনও গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেশি, কোনও গাড়ির কম।” রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম হলে গাড়ি স্বাভাবিক ভাবেই পছন্দের হয়। তবু সন্তানসম গডকড়ীকে আজ বিজেপি সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করলেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। পাশাপাশি, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বিস্তর হলেও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সঙ্ঘ পরিবার প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী করার কথা ভাবছে বলে খবর। ফেব্রুয়ারিতে বিজেপি-র জাতীয় সম্মেলনে তাঁকে নির্বাচন প্রচার কমিটির প্রধান করে দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
বিজেপি সূত্র বলছে, গডকড়ীকে সভাপতি রাখতে পারলে ভাগবত খুশি হতেন। তার থেকেও বেশি খুশি হতেন ভারতে গো-হত্যা বন্ধ করতে পারলে, বা সব ভারতবাসী নিরামিষাশী হয়ে উঠলে। কিন্তু সরসঙ্ঘচালক জানেন, সেই সব ইচ্ছা পূরণের আশু সম্ভাবনা যেমন নেই, তেমনই গডকড়ীকে
আর এক বার বিজেপি সভাপতি করা যাবে না।
এটা ঠিক যে, গডকড়ীর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন খোদ লালকৃষ্ণ আডবাণী। কিন্তু শুধু সেই কারণে আরএসএস সভাপতি বদলের সিদ্ধান্ত নিল, এই ব্যাখ্যা অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন বিজেপি-রই এক শীর্ষ নেতা। কারণ, সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র পারস্পরিক রাজনীতি নিছক সাদা-কালো নয়, বহুস্তরীয়। বিজেপি নেতা যশবন্ত সিন্হা অবশ্য বলেন, “আডবাণী দলে প্রবীণতম ব্যক্তিত্ব। তিনি সৎ বলে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে হাওলা কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেও নরসিংহ রাও কিছু প্রমাণ করতে পারেননি। দুর্নীতির প্রশ্নে তিনি কোনও আপস করেন না। ফলে আডবাণীর মতামতের একটা মূল্য রয়েছে।”
আরএসএস সূত্র কিন্তু বলছে, জিন্না-বিতর্কের সময় আডবাণী সম্পর্কে সঙ্ঘের সেই যে মোহ ভঙ্গ হয়েছিল, আজও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। আরএসএস আডবাণীর হাতে কার্যত অবসরের বিজ্ঞপ্তি ধরিয়ে দিয়েছে। তবে দলীয় স্তরে পরিবর্তন বা সিদ্ধান্তগ্রহণ আলোচনায় যে তাঁকে রাখা হচ্ছে, তাঁর মতামত শোনা হচ্ছে, সেটা শিষ্টাচার। সঙ্ঘের নেতারা আডবাণীর বাড়ি গিয়ে দুনিয়ার সামনে রাজনৈতিক ভব্যতা দেখাচ্ছেন। |
|
নতুন সভাপতিকে অভ্যর্থনা। বুধবার। ছবি: পিটিআই |
তা হলে গডকড়ী বিদায়ের বৃহৎ প্রেক্ষাপটটি কী?
বিজেপি নেতারা বলছেন, আডবাণীর ভূমিকা যেমন রাজনৈতিক অনুঘটকের কাজ করেছে, তেমনি গডকড়ীর বিরুদ্ধে আয়কর দফতরের তদন্ত কাজ করেছে প্রশাসনিক অনুঘটক হিসেবে। দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে গডকড়ীর বিরুদ্ধে যে একটা জনমত তৈরি হয়েছে, সেটা বুঝতে নাগপুরের অসুবিধা হচ্ছিল না। আর সেই কারণেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গডকড়ীকে রাখার চেষ্টা হলেও আরএসএস নেতৃত্ব ভিতরে ভিতরে বিকল্প কৌশলটিও তৈরি করে রেখেছিলেন। সেই তুরুপের তাসটি হলেন রাজনাথ সিংহ।
গডকড়ীকে বদলে কে, এই আলোচনায় গেলে যে ফর্দটি হাতের সামনে থাকে তার নামগুলি হল অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, যশবন্ত সিন্হা, রাজনাথ সিংহ, মুরলীমনোহর জোশী এবং লালকৃষ্ণ আডবাণী। আডবাণীকে লোকসভা ভোটে দাঁড়াতে বারণ করে তাঁর পরিবারের কাউকে নির্বাচনে লড়তে অনুরোধ করছেন ভাগবত। ফলে তাঁকে সভাপতি করার প্রস্তাব আরএসএস দেবে না। অরুণ ও সুষমার দ্বৈরথ অব্যাহত। সেখান ভারসাম্য রক্ষা করে কাউকেই ওই পদ না-দেওয়াই আরএসএসের কৌশল। তাই আডবাণী নিজে সুষমার নাম প্রস্তাব করলেও আরএসএস মানেনি। আবার অরুণের নাম আডবাণীই খারিজ করে দেন।
এই রেষারেষি আরএসএসের পথ পরিষ্কার করেছে।
অন্য দিকে, অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন যশবন্ত সিন্হার সঙ্গে বিরোধের কথা আরএসএস ভোলেনি। তার চেয়েও বড় কারণ হল যশবন্ত আরএসএস-করা লোক নন। প্রাক্তন সরসঙ্ঘচালক সুদর্শনের ঘনিষ্ঠ মুরলীমনোহর জোশীও এখন আর আরএসএসের খুব একটা পছন্দের নন। ফলে পড়ে রইলেন রাজনাথ।
কিন্তু রাজনাথকে দিয়ে খুব একটা কাজ হবে না, সেটা আরএসএস বিলক্ষণ জানে। তিনি গত লোকসভা ভোটের সময় বিজেপি সভাপতি ছিলেন। এবং ব্যর্থ বলে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন। এমনকী, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতেও যে রাজনাথ নির্ণায়ক শক্তি নন, তা-ও আরএসএসের অজানা নয়। ফলে আরএসএসের অঙ্গুলি হেলনে চলতে অভ্যস্ত রাজনাথের ভূমিকা এ বার হবে মূলত নির্বাচনী ম্যানেজারের।
এই অবস্থায় বিশ্বস্ত প্রতিভূ রাজনাথকে সামনে রাখলেও দিল্লির কুর্সি দখলের যুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীকেই তুলে আনার পরিকল্পনা নিচ্ছে আরএসএস। বিজেপি সূত্রও বলছে, রাজনাথ যখন এলেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে মোদীর নাম ঘোষণার সম্ভাবনা বাড়ল বলেই মনে হয়। আজ ১১, অশোক রোডে জড়ো হওয়া দলীয় কর্মীরাও চাইছেন, মোদীই প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী
হোন। নরেন্দ্র মোদী দলের মধ্যে এই নৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করেছেন। মোহন ভাগবত জানেন, এই নৈতিক প্রতিরোধেই গডকড়ীকে সরতে হয়েছে। এই নৈতিক চাপই প্রশস্ত করছে নরেন্দ্র মোদীর পথ।
সেটাই দেওয়াল লিখন। |
|
|
|
|
|