পুলিশের দাবি মানতে নারাজ বাবা
ম্যাঞ্চেস্টারের খালে মিলল শৌভিকের দেহ
নিখোঁজ হওয়ার ২২ দিন পরে, ভারতীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ম্যাঞ্চেস্টারের ব্রিজওয়াটার খাল থেকে পাওয়া গেল বাঙালি যুবক শৌভিক পালের দেহ। কপালে পুরনো কাটা দাগ দেখে বাবা শান্তনু পাল দেহটিকে শৌভিকের বলে শনাক্ত করেন। প্রাথমিক ময়না-তদন্তের পরে ম্যাঞ্চেস্টার পুলিশ মৃত্যুর সঠিক কারণ জানাতে পারেনি। তাদের দাবি, শৌভিকের দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। তাঁকে খুন করা হয়েছে বলে কোনও প্রমাণ তারা পায়নি। আবার ওই যুবক যে আত্মহত্যা করেছেন, তা-ও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না ম্যাঞ্চেস্টার পুলিশ। তাদের মনে হয়েছে, শৌভিকের মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা।
পুলিশের এই দাবি কিন্তু মানতে নারাজ শৌভিকের বাবা শান্তনুবাবু। তাঁর মনে হয়েছে, এই মৃত্যুর পিছনে কোনও রহস্য রয়েছে। বুধবার ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ফোনে বলেন, “আমি ম্যাঞ্চেস্টারে থাকা সত্ত্বেও আমাকে স্থানীয় খালে মৃতদেহ পাওয়ার কথা কেউ জানায়নি। আমাকে বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে খবরটা জানানো হয়েছে। কোনও অপরিচিত ব্যক্তি মঙ্গলবার রাত ১০টায় আমার স্ত্রী মহুয়াকে বেঙ্গালুরুর বাড়িতে ফোন করে ঘটনাটি জানান। বেঙ্গালুরু থেকে আমারই এক প্রতিবেশী ফোন করে আমাকে জানান। আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। এর পরে বিবিসি-র খবর দেখে নিশ্চিত হই।” ভারতীয় সময় রাত একটা নাগাদ সেখানকার পুলিশ হোটেলে এসে শান্তনুবাবুকে নিয়ে যায় হাসপাতালে।
বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট্ট শৌভিক। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া ছবি।
বুধবার ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ফোনে শান্তনুবাবু বলেন, “আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রথমে শৌভিকের পাসপোর্ট, কলেজের পরিচয়পত্র ও ঘড়ি দেখানো হয়। তার পরে দেখানো হয় ওর মুখ। তাও এক দিকে পাশ ফেরানো। মাথার কাটা দাগ দেখে চিনতে পারি।” ম্যাঞ্চেস্টার পুলিশ বুধবার রাতেই শৌভিকের দেহ শান্তনুবাবুর হাতে তুলে দিয়েছে। তবে, তাঁর দেহ ভারতে আনার জন্য আরও পাঁচ দিন সেখানে অপেক্ষা করতে হবে শান্তনুবাবুকে। অনেক কাগজপত্র যোগাড় করতে হবে বলে শান্তনুবাবু জানান। ছেলের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ কাটাতে শান্তনুবাবু ছেলের দেহ ভারতে নিয়ে এসে ফের ময়না-তদন্ত করাতে চান।
শৌভিকের মৃত্যু যে নেহাত দুর্ঘটনা নয়, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অনেক কারণ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন শান্তনুবাবু। ৩১ ডিসেম্বর রাতে শৃঙ্খলা ভাঙার জন্য ম্যাঞ্চেস্টারের নাইট-ক্লাব ‘ওয়্যারহাউস প্রজেক্ট’-এর ভিতর থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল ১৯ বছরের শৌভিককে। সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান শৌভিক। ৪ জানুয়ারি ওই নাইট-ক্লাবের কাছেই ব্রিজওয়াটার খালে ডুবুরি নামানো হয়। কিন্তু সে বার সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। শান্তনুবাবুর প্রশ্ন, “১৮ দিন পরে সেই খাল থেকেই কী করে মিলল ছেলের দেহ?” তাঁর সন্দেহ, ৪ জানুয়ারির পরে শোভিকের দেহ কে বা কারা খালে ফেলে দিয়ে গিয়েছে।
ছেলের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানার পরে এ মাসের গোড়া থেকেই শান্তনুবাবু ম্যাঞ্চেস্টারে রয়েছেন। প্রতি দিন যোগাযোগ রেখে চলেছেন স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও পুলিশ তাঁকে মৃতদেহ উদ্ধারের বিষয়টি কেন গোপন করে গেল, সেই প্রশ্নের কোনও জবাব শৌভিকের বাবা স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে পাননি।
ম্যাঞ্চেস্টার পুলিশের তদন্তকারী অফিসার ডিটেকটিভ চিফ ইন্সপেক্টর কলিন লারকিন ফোনে বলেন, “শৌভিককে খুন করা হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। এমনকী তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলেও আমাদের মনে হচ্ছে না। হতে পারে, এটা দুর্ঘটনা। তিনি খালে পড়ে গিয়েছিলেন।” পুলিশের এই যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন শান্তনুবাবু। তিনি বলেন, “শৌভিক সাঁতার জানত। আমার কাছেই ও সাঁতার শিখেছে। মাত্র ২০ ফুট চওড়া একটা খালে পড়ে গেলে ও উঠতে পারবে না, এটা হতে পারে না।”
লারকিন বলছেন, “অনেক সময় সাঁতার জানা লোকও তলিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়াও আরও কিছু দিক রয়েছে। আমরা সেগুলিও খতিয়ে দেখছি।” কিন্তু শৌভিকের সঙ্গে যে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিল, তা কোথায় গেল, সেই প্রশ্নের জবাব ম্যাঞ্চেস্টার পুলিশের গোয়েন্দা-কর্তা দিতে পারেননি। পুলিশের কেউ কেউ শৌভিকের অতিরিক্ত মদ্যপান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। শান্তনুবাবুর মন্তব্য, “৩১ ডিসেম্বর রাতে সাড়ে ন’টায় নাইটক্লাবে ঢুকেছিল শৌভিক। রাত এগারোটায় বেরিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে একজন কতটা মদ খেলে এমন বেহেড হয়ে যায়, সেই প্রশ্নের জবাবও আমি পাইনি। আমি আমার ছেলের মৃত্যুর যথাযথ কারণ জানতে চাই।”
ছেলেকে খুঁজে পেতে আকাশ-পাতাল এক করে ফেলেছিলেন শান্তনুবাবু। অনুরোধ করেছিলেন স্থানীয় ট্যাক্সিচালকদের। ম্যাঞ্চেস্টার ফুটবল ম্যাচের সময় দর্শকদের সামনে ছেলের ছবি-সহ পোস্টার তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “ম্যাঞ্চেস্টারে আসার পরে ও কেন হারিয়ে গেল, ভাবিনি। ওকে খুঁজে পাওয়াই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়ার, এ ভাবে চলে যাওয়ার কারণটাও তো জানা দরকার।”
মঙ্গলবার রাত ১০টায় টেলিফোনে খবরটা পাওয়ার পর থেকেই প্রায় নির্বাক মা মহুয়াদেবী। শৌভিকের ভাই অর্ক ক্লাস থ্রি-র ছাত্র। দাদার মৃত্যুসংবাদ তাকে জানানো হয়নি। শৌভিকের পৈত্রিক বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে। সেখানেও পৌঁছে গিয়েছে খবরটা। শৌভিকের ঠাকুরদা অলোক পাল আপাতত সস্ত্রীক বেঙ্গালুরুতে আছেন। বছরে অন্তত দু’বার বাবা-মা-ভাইয়ের সঙ্গে ঘাটালের বাড়িতে আসতেন শৌভিক। শেষ এসেছিলেন ২০১১ সালের পুজোয়। দেশে ফিরলে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলতেন ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে। ঘাটালেই শৌভিকের মামাবাড়ি। মামা সৌরভ ঘোষ বলেন, “ভেবেছিলাম, এত চেষ্টা হচ্ছে, শৌভিককে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এমন খবরের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।”

(সহ প্রতিবেদন: অভিজিৎ চক্রবর্তী, ঘাটাল)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.