বিধি ভেঙে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার খাতা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক আরও দানা বাঁধল। রবিবার সকালে সিল করা দু’টি ট্রাঙ্ক ভর্তি ওই খাতা কলকাতা থেকে এনে শিলিগুড়ি থানায় দেন প্রাথমিক স্কুল সংসদের চেয়ারম্যান সমর চক্রবর্তী। ঘটনায় ফের জড়িয়েছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের নামও। কারণ, খাতা যে ট্রেনে কলকাতায় গিয়েছে, তাতে ছিলেন মন্ত্রী। যে ট্রেনে আনা হয়েছে, তাতেই ফিরেছেন মন্ত্রীও। কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, মন্ত্রীর মাধ্যমে খাতা পাঠানো বেআইনি। প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান সমরবাবু বলেন, “ঘটনায় মন্ত্রীর নাম জড়ানো দুর্ভাগ্যজনক। দু’দিনই ট্রেনে মন্ত্রী থাকার বিষয়টি কাকতালীয়।”
পাশাপাশি, চেয়ারম্যান বলেন, “ট্রেজারি বন্ধ থাকায় খাতা থানায় রাখতে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। এক বোর্ড সদস্য ছাড়াও প্রাথমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে অভিযোগ তুলেছেন। সে জন্য স্বচ্ছতা বজায় রাখতে তা সিল করা অবস্থাতেই ফেরানো হয়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক ডেকে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।” |
চেয়ারম্যানের দাবি মানতে নারাজ কংগ্রেসের শাখা সংগঠনের সদস্যরা। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, চুপিসাড়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর মাধ্যমে খাতা কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ফাঁস হওয়ায় সংসদ বিপাকে। সে জন্য বিতর্ক আড়াল করতে খাতা এনে থানায় জমা রাখা হয়েছে বলে তাঁদের সন্দেহ। আজ, সোমবার ফের শিলিগুড়ি প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের অফিসে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। কংগ্রেস কাউন্সিলর তথা শিলিগুড়ি প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সদস্য রুমা নাথ বলেন, “গোটা ঘটনায় অস্বচ্ছতা সামনে এসেছে। তা না হলে বোর্ড মিটিংয়ে কেন খাতা কলকাতায় পাঠানোর ব্যপারে কোনও আলোচনা হল না? আর খাতা নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে নিয়ে এসে থানায় জমা রাখার বিষয়টি গোপন রাখা হল? মিটিং ডেকে চেয়ারম্যান যাতে সব প্রশ্নের উত্তর দেন সে দাবি জানাব।”
শিক্ষক কল্যাণ সমিতির নেতা বিভাস চক্রবর্তী ওই ঘটনা নিয়ে তদন্তের দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা চাই মেধার ভিত্তিতে প্রাথমিকে নিয়োগ হোক। কিন্তু খাতা নিয়ে যা হচ্ছে তাতে আশঙ্কা করছি ভাল ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হবেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হোক।” উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ডিএওয়াইএফআইয়ের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ। তিনি বলেন, “খাতা নিয়ে এই ধরণের ঘটনা আমরা কখনও শুনিনি। মন্ত্রীর নামও ঘটনায় জড়িয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা দরকার।” দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস (সমতল) এর মুখপাত্র অভিজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, “ঘটনা পরম্পরা যেন ঠাকুরঘরে কে, আমি কলা খাইনি প্রবাদের মতো।”
তৃণমূলের তরফে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ওই বিষয়ে কিছুই জানে না। তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা মহাসচিব কৃষ্ণ পাল বলেন, “উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী যে ভাবে উন্নয়নে গতি এনেছেন, তাতে কংগ্রেস, সিপিএমের আমাদের বিরুদ্ধে বলার মতো কিছু নেই। সস্তা প্রচারের জন্য মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব কথা বলছেন কয়েকজন। রাজ্য সরকার প্রাথমিকে ৩৫ হাজার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। সে সময় এই অভিযোগ তোলা হচ্ছে। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্যের জন্য আমরা আদালতে যাব।”
সংসদ সূত্রের খবর, ২০০৯ সালে জলপাইগুড়িতে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দার্জিলিং জেলায় পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। গত ৯ ডিসেম্বর ওই পরীক্ষা দেন ১,১৪৬ জন ছাত্রী। এদের মধ্যে ১৭১ জনকে নেওয়া হবে। অভিযোগ ওঠে, গত বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর মাধ্যমে ওই খাতা কলকাতায় পাঠানো হয়। তা নিয়ে দুর্নীতির আশঙ্কা করে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের এক আধিকারিক সিদ্ধান্ত মোক্তানকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান কংগ্রেসের শাখা সংগঠনের সদস্যরা। সে সময় সিদ্ধান্তবাবু জানান, ওই খাতা সংসদের এক কর্মী অর্জুন বর্মনের মাধ্যমে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কি কারণে তা কলকাতায় পাঠানো হয়েছে তা নিয়ে অস্পষ্টতা থেকে যায়।
এদিন সকাল ১০টা নাগাদ চেয়ারম্যান ওই খাতা থানায় জমা রেখে চলে যান। সাড়ে ১১টা নাগাদ পুলিশ কর্তারা চেয়ারম্যানকে ফের ডেকে পাঠিয়ে খাতা জমা রাখার জন্য জেলাশাসক অথবা মহকুমাশাসকের অনুমতি লাগবে বলে জানান। চেয়ারম্যান সেই খাতা নিয়ে একবার মহকুমাশাসকের দফতর এবং সার্কিট হাউসে ঘুরে বেড়ান। শেষপর্যন্ত ১টা নাগাদ একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত নির্দেশে ওই খাতার দুটি ট্রাঙ্ক থানায় জমা রাখা হয়। চেয়ারম্যান বলেন, “উত্তরপত্রের অবজেকটিক বিভাগের প্রশ্ন কলকাতা থেকে হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই ওই কম্পিউটার সেন্টারে তা পাঠাতে হবে। বাকি খাতা শিক্ষকদের দিয়ে দেখানো হবে। বিতর্ক ওঠায় তা নিয়ে আসা হলেও ফের তা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে।” |