নারী নিগ্রহের ঘটনার নিরিখে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশে সবার উপরে। গত মে মাসে কেন্দ্রীয় এই পরিসংখ্যান প্রকাশ পাওয়ার পরে রাজ্যের অপরাধ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-য় পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে মহাকরণ। ফলে দেশের অপরাধ-তথ্যপঞ্জির পরবর্তী সংস্করণ (যা ২০১৩-য় প্রকাশের কথা) কী ভাবে নির্দিষ্ট সময়ে বার করা যাবে, সে সম্পর্কে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে।
এনসিআরবি সাধারণত মে-জুন মাসে জাতীয় অপরাধ-তথ্যপঞ্জি প্রকাশ করে। ব্যুরোর এক কর্তা বলেন, “প্রতি মাসের শেষে রাজ্যগুলো জেলাওয়াড়ি তথ্য পাঠায়। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে আসে গোটা বছরের সংগৃহীত তথ্য। কিন্তু গত জুনের পরে পশ্চিমবঙ্গ মাসিক রিপোর্ট পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।” বলেন ব্যুরোর এক কর্তা। এতে যে পরবর্তী প্রকাশনায় সমস্যা হবে, তা জানিয়ে এনসিআরবি-র ডিজি মাস দু’য়েক আগে রাজ্যকে চিঠি দিয়েছেন। সাড়া না-মেলায় ফের চিঠি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তথ্য পাঠানো বন্ধ হল কেন?
মহাকরণের পুলিশ-কর্তারা মুখ খোলেননি। তবে প্রশাসনিক সূত্রের খবর: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সরকারের প্রথম বছরেই পশ্চিমবঙ্গের এই ‘রেকর্ড’ জেনে ক্ষুব্ধ। তিনি মনে করেন, এ ভাবে শুধু পরিসংখ্যান দেওয়ায় রাজ্যের ‘মর্যাদাহানি’ হয়েছে। পুলিশের কর্তাদের ডেকে সে কথা জানিয়েও দেন তিনি। আর তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের নির্দেশে রাজ্যের অপরাধ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য দিল্লিতে পাঠানো বন্ধ করে দেয় পুলিশ। পরিসংখ্যানে আপত্তিটা কী?
প্রশাসনের এক মহলের যুক্তি: মহিলাদের উপরে অত্যাচার বেড়েছে কি না, নিছক পরিসংখ্যান তার সূচক হতে পারে না। এই মহলের দাবি: অন্য রাজ্যে নিগৃহীতা মহিলাদের অনেকে ভয়ে ও সামাজিক বাধায় থানায় যেতে সাহস পান না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা পারেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোও অনেক বেশি সক্রিয়। তাই পশ্চিমবঙ্গে বেশি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।
এবং এই যুক্তির ভিত্তিতে পরিসংখ্যানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ঘটনার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও তুলে ধরার দাবি জানিয়ে এনসিআরবি-কে চিঠি লিখেছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই সুরে চিঠি লেখেন বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
তবে রাজ্যের কথা এনসিআরবি মানেনি। পাল্টা চিঠিতে ব্যুরো বলেছে, তাদের তথ্যপঞ্জিতে শুধু পরিসংখ্যানই থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ চাইলে নিজের মতো করে অপরাধ-পুস্তিকা তৈরি করতে পারে। রাজ্য তাতে রাজি হয়ে যায়। অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য পেশের পাশাপাশি ঘটনার প্রেক্ষিত ও তদন্তের সাফল্যের খতিয়ান বিস্তারিত ভাবে জানানোর জন্য প্রতিটি জেলার পুলিশকে নির্দেশ পাঠায় মহাকরণ। যদিও সে কাজও খুব একটা এগোয়নি।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় অপরাধ-তথ্যপঞ্জি আরও মজবুত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। “প্রকাশনার ঢং না-বদলালেও অপরাধের নানা ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান কী ভাবে আরও সুনির্দিষ্ট চেহারায় পেশ করা যায়, তা জানতে সব রাজ্যের মত চাওয়া হচ্ছে।” বলেন এনসিআরবি-র এক কর্তা। যার অঙ্গ হিসেবে গত ১০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ-উত্তরপ্রদেশ-দিল্লি-পঞ্জাব-মহারাষ্ট্র-রাজস্থানের পুলিশ-কর্তাদের ডেকে পাঠিয়েছিল ব্যুরো। বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের তরফে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কী রকম?
যেমন, নারী নিগ্রহের অভিযোগ সরাসরি থানায় অথবা কোর্ট মারফত লিপিবদ্ধ হয়ে থাকলে তথ্যপঞ্জিতে আলাদা ভাবে উল্লেখ করা হোক। আবার বর্তমান তথ্যপঞ্জিতে ‘অত্যাচারিতাদের’ নাবালিকা ও সাবালিকা হিসেবে ভাগ করা হয়। রাজ্যের প্রস্তাব, ‘নাবালিকা’র মধ্যেই আর একটা অতিরিক্ত স্তর (০-১২ বছর এবং ১২-১৮ বছর) থাকা উচিত, যাতে কোন বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। উপরন্তু মাদক আটক কিংবা অস্ত্র-বিস্ফোরক উদ্ধারের মতো যে সব কৃতিত্বের কাজ পুলিশ করে থাকে, জাতীয় অপরাধ-তথ্যপঞ্জিতে সে সবেরও উল্লেখ থাকা জরুরি বলে রাজ্য মনে করছে। |