কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান। সিঁদুরের লাল ধুয়ে গেল রক্তের ফোয়ারায়। তার এক ঘণ্টার মধ্যে বিয়েবাড়ির মেঝেতে পড়ে রইল দু’দু’টো মৃতদেহ। নিহত বর আর বরের আততায়ী তথা পাত্রীর ‘প্রাক্তন প্রেমিক’।
শনিবার রাতে হালিশহরের বিয়েবাড়িতে সবেমাত্র শেষ হয়েছিল সিঁদুর দান-পর্ব। ফোটোগ্রাফারের অনুরোধে টোপর মাথায় বর আর ঘোমটা টানা বউ পাশাপাশি বসে হাসিমুখে ছবি তুলছিলেন। এক যুবক বরের দিকে এগিয়ে গেল। জ্যাকেটের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল ওয়ান-শটার। আর নিমেষের মধ্যে গুলিটা বরের কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। আঠাশ বছরের শৌভিক দে বিয়ের জোড় গায়ে নিয়েই লাশ হয়ে গেলেন।
ডাকাত পড়ল নাকি? অতিথি-অভ্যাগতরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমটা। তিন তলায় বরযাত্রীদের খাওয়াদাওয়া দেখভাল করছিলেন পাত্রীর মামা। ছেলে-ছোকরারা বাজি ফাটাচ্ছে ভেবে তড়িঘড়ি নেমে এলেন তিনি। মাফলারে মুখ ঢেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল এক যুবক। “রা-জী-ই-ব!” তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলেন সদ্য-পরিণীতা থেকে সদ্য-বিধবায় রূপান্তরিত হওয়া বছর একুশের মেয়েটি, তাঁর লাল বেনারসীতে ছিটকে এসেছে তাজা রক্ত।
সম্বিৎ ফিরল বিয়েবাড়ির। সকলে মিলে ঘিরে ধরল সেই ‘রাজীব’কে। কাঁচরাপাড়ার নিউ কলোনির বাসিন্দা রাজীব বসু (২৫)। হাতের কাছে যে যা পেল, তাই নিয়ে ঘিরে ধরে শুরু হল মার। এক ঘণ্টা আগেও যাঁরা সেজেগুজে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছিলেন, তাঁরা সেই চেয়ার নিয়েই তেড়ে গেলেন খুনির দিকে। আর যে ভিডিও ক্যামেরায় এতক্ষণ ধরে তোলা হচ্ছিল বিয়ের চলচ্ছবি, তাতেই এ বার বন্দি হতে থাকল ‘লাইভ’ গণপ্রহার। |
“মেরেই ফেলব ওকে, বেঁচে ফিরতে দেব না।” বারবার বলছিল জনতা। ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে, রাজীব খুব একটা আত্মরক্ষার চেষ্টাও করেনি। সে সম্ভবত নিজের ভবিতব্যের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। একটু পরে ক্যামেরার ফ্ল্যাশগানের তার টেনে নিয়ে তার গলায় ফাঁস দিয়ে টানতে থাকল জনতা। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ-কর্তা পরে বলছিলেন, “ভিডিও ক্যামেরার তার দিয়ে প্যাঁচানো হয়েছিল রাজীবকে। পুলিশ ওকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নিয়ে যায় নৈহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসকেরা রাজীবকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।”
কেন শৌভিককে মারল রাজীব? ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ বলছেন, ‘‘প্রণয়ঘটিত কারণেই খুন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে। বরের দিদি পুলিশের কাছে বিবৃতি দিয়েছেন।” পুলিশের দাবি, এক সময় নিজেকে কাঁচড়াপাড়ার এক নামী বস্ত্রবিপণির মালিক বলে পরিচয় দিয়ে মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছিল রাজীব। পরে জানা যায়, ওই দোকানের কর্মচারী সে। তাতেই সম্পর্কে চিড় ধরে। কিন্তু মেয়েটির পরিবারের দাবি, রাজীবের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না মেয়েটির। বরং বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় মেয়েটিকে উত্যক্ত করত রাজীব। গত বছর ৮ মে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে গোলমাল বাধানোর জন্য বীজপুর থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল। পুলিশ জানাচ্ছে, রাজীব মুচলেকা দিয়ে তখনকার মতো বিষয়টি মিটমাট করে নেয়। তার পর থেকে এ পর্যন্ত সে মেয়েটির সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু এক ভয়ানক রাগ আর প্রতিশোধস্পৃহা মনে পুষে রেখেছিল বলেই পুলিশের ধারণা।
কিছু দিন আগে বাবার বন্ধুর ছেলে শৌভিকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় মেয়েটির। শনিবার হালিশহরের নবনগরে ছিল বিয়ের আসর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, রাত সাড়ে আটটা থেকেই মাফলার পরিহিত রাজীবকে বিয়েবাড়িতে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিলেন তাঁরা। সন্দেহজনক কিছু মনে হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠান চলতে কোনও বাধাও দেয়নি রাজীব। নিঃশব্দে অপেক্ষা করে গিয়েছে শুধু সিঁদুরদান পর্ব মেটার জন্য। রাত সওয়া ১১টা। এক প্রতিবেশীর কথায়, ‘‘খাওয়া-দাওয়া সেরে নবদম্পতির সঙ্গে দেখা করে বেরোচ্ছি। তখনই গুলির শব্দ।”
ঘণ্টা দুয়েক পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা যায়, বিয়েবাড়ি রক্তে ভাসছে। উৎসবের আলোগুলো তখনও জ্বলছে। খাবারদাবার, উপহার সামগ্রী লন্ডভন্ড। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি শুধু বলছিল, “আমার সব শেষ হয়ে গেল!” পুলিশ শৌভিক এবং রাজীবের দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে যথাক্রমে কল্যাণী ও নৈহাটির হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। আগ্নেয়াস্ত্রটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। রাতেই এলাকা ঘুরে যান সাংসদ মুকুল রায় এবং শুভ্রাংশু রায়। রাজীবের বাড়ির লোকজন ঘটনার পর থেকেই পলাতক । শৌভিকের বাবা বাসুদেব দে বলেন, “কিছু বলতে পারব না। আমি কথা বলার অবস্থায় নেই।”
রবিবারও সারা দিন থমথম করেছে হালিশহর-কাঁচড়াপাড়া। আগের দিন সন্ধেয় ফুলে ঢাকা গাড়িতে চড়ে বিয়ে করতে এসেছিলেন শৌভিক।, রবিবার সন্ধেয় ওই বিয়েবাড়ির সামনে দিয়েই গেল সাদা ফুলে ঢাকা একটা কাচের গাড়ি। তার মধ্যে শব হয়ে শুয়ে শৌভিক। |