|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
নৈহাটি থেকে নাইটক্লাব
নাইটক্লাব যাওয়া মানেই বিরাট খরচা। কে বলল? বুদ্ধি থাকলে
পকেট মানি বাঁচিয়েই হুল্লোড় করা যায়। লিখছেন অরিজিৎ চক্রবর্তী |
“এই তাড়াতাড়ি ওঠ। লাস্ট মেট্রোটা ধরতেই হবে...”
“ধুর ট্যাক্সি নিয়ে নিস।”
“ট্যাক্সির টাকা কি তোর বাবা দেবে?”
সাধারণ কথাবার্তা। কিন্তু যদি বলা হয় উপরের কথোপকথনটা কোনও নাইট ক্লাবের ভিতরের? আকাশ থেকে পড়লেন? না, নাইট ক্লাব আর মোটেও বড়লোকের ছেলে-মেয়েদের এক্সক্লুসিভ জায়গা নয়। প্লে-স্টেশন, আই পডের মতো ‘নাইট ক্লাব’ও জায়গা করে নিয়েছে মধ্যবিত্তের ডিকশনারিতে। তাদের আগের প্রজন্মের কাছে হয়তো নাইট লাইফ মানে ছিল কেবল পুজোয় সারারাত ঠাকুর দেখা।
সত্যিই কি তাই? মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়েরাও কি এখন ভিড় জমাচ্ছে নাইট ক্লাবে? নাইট ক্লাবে খরচের টাকাটাই বা পাচ্ছে কী করে?
যদি টাকা লাগে...
“টাকাটা মোটেই সমস্যার নয়। কত টাকাই বা লাগে? চাইলে ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যেই পার্টি করা যায়। অনেক নাইট ক্লাবে তো এন্ট্রি ফি নেই, শুধু ড্রিঙ্কসের যা খরচ। আর প্রতিদিন তো যাচ্ছি না। যাচ্ছি বড়জোর মাসে দু’-তিনবার। ওটা ম্যানেজ হয়ে যায়,” জানালেন শুভদীপ। আশুতোষ কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের এই ছাত্রের বাবা এক সরকারি অফিসের কর্মচারী, মা গৃহবধূ। |
|
“আমার তো অ্যাভারেজ খরচ হয় ২৫০ টাকার কাছাকাছি। দু’টো টিউশন থেকে মাসে ১৮০০ টাকা পাই। বার চারেক নাইট ক্লাব গিয়েও টাকা বাঁচে,” বলছিলেন মনীষা। তিনিও বিএ সেকেন্ড ইয়ার। ‘বেসমেন্ট’-এর ম্যানেজার সুদীপ্ত দেও সমর্থন করলেন ওদের কথা, “একদম তাই। কিছু কিছু গ্রুপ আছে যারা প্রচুর খরচ করে। কিন্তু এমনও গ্রুপ দেখি যারা চারজনে ১২০০ টাকার মধ্যেই মিটিয়ে ফেলে।”
ককটেল বানানোর ফাঁকেই একটা মজার কথা শোনালেন বার টেন্ডার নীতীশ, “আপনি যে ধরনের লোকেদের কথা বলছেন, তাদের হাবেভাবেই সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারি। ড্রিঙ্কস্ নেওয়ার আগে দামটা জিজ্ঞেস করে নেয়।”
প্রথম ক্লাবের দিনটা...
প্রায় সবারই প্রথম নাইট ক্লাবে আসা কোনও নাইট ক্লাব বোদ্ধা মানুষের সঙ্গে। তার পর অনেকেই হয়ে উঠেছে নাইট ক্লাব বোদ্ধাদের একজন। কিন্তু কেমন ছিল প্রথম নাইট ক্লাবে আসার দিনটা?
“আমার প্রথম আসা এক বন্ধুর বার্থ ডে পার্টিতে। সেদিনই প্রথম শুনি ‘ক্যাসিনিজ ডিভিশন’ ব্যান্ড। আমাদের জেনারেশন অলটারনেটিভ গান শুনতে খুব পছন্দ করে। সে অলটারনেটিভ রক হোক কী অলটারনেটিভ জ্যাজ। আমিও আলাদা নই। ওটা একটা বড় ফ্যাক্টর। শুধু ড্রিঙ্কস্ বা পার্টির টানে সবাই আসছে ভাবলে খুব ভুল হবে। গান শুনতেও কিন্তু অনেকে আসে। আমি তো অলটারনেটিভ মিউজিক যেখানে হয়, বন্ধুবান্ধব মিলে হাজির হই সেখানে,” বলছিলেন অর্ক। পড়েন প্রেসিডেন্সি কলেজে, বাড়ি সোদপুর। |
মনে রাখুন |
• যে কোনও সমস্যা এড়াতে কমপক্ষে চার-পাঁচ জন মিলে ক্লাবে যান
• ক্লাবে অহেতুক বেশি রাত করবেন না। ডিজে নাইটের বদলে ব্যান্ড নাইটে যান। ওটা অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়
• অনেক ক্লাবই এখন দুপুর থেকেই খোলা। বন্ধুদের নিয়ে সেখানে ঢুঁ মারুন। বাড়ির পারমিশন নেওয়ার চাপ থাকবে না
• দুপুরে ভাল করে লাঞ্চ করুন। খালি পেটে ড্রিঙ্ক করলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না
• ফ্যান্সি ককটেলের বদলে রেগুলার ড্রিঙ্কস্ নিন। জমিয়ে ক্লাবিংয়ের পরেও ওয়ালেট মোটাই থাকবে |
|
গানটা যে ক্লাবে আসার একটা বড় ফ্যাক্টর সেটা আর বলে দিতে হয় না। সৌম্যদীপের ক্লাবিংয়ের আসল টান যেমন ‘স্যাটারডে নাইট ব্লুজ’, অঙ্কিতার তেমনই ‘ফিল্ডার্স গ্রিন’। তবে আসে স্রেফ পার্টি করতে। “আমার ক্লাবে আসার একমাত্র কারণ চিল করা,” বলছিলেন সৌরিণী, “এখন তো চাকরি করি। কিন্তু যখন কলেজে পড়তাম, পকেট মানির টানাটানি, তখনও মাসে অন্তত দু’বার চলে যেতাম ‘সৌরভস্’য়ে। বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণ খুলে নাচতে। হোস্টেলে না থেকে মেসে থাকতাম তাই একটু রাত হলেও অসুবিধা হত না। দুপুরের লাঞ্চ মানি সেভ করেই ক্লাবে গেছি কত বার।”
প্রায় একই কথা বললেন সুদীপ্ত দে, “ক্রাউডের মধ্যে এই তফাতটা বেশ স্পষ্ট। ব্যান্ড নাইট আর ডিজে নাইট-এ আসা পাবলিকের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। লক্ষ করে দেখেছি মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা ব্যান্ড নাইটটাই বেশি প্রেফার করে। ডিজে নাইটে যে আসে না তা নয়। তবে কম।”
বাড়ি ফিরব কী করে...
লাঞ্চের টাকা বাঁচিয়ে বা টিউশনি করে নাইট ক্লাবে আসার টাকা নয় ম্যানেজ করা গেল। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনও ছেলে বা মেয়ে রাতবিরেতে বাড়ি ফিরছে, এটা বাড়ি থেকে অ্যালাউ করে?
“কে বলল রাতবিরেতে বাড়ি ফিরছি? ক্লাবিং করতে রাতের বেলাতেই খালি যেতে হবে নাকি? আমরা তো দুপুরে যাই। আবার সন্ধের মধ্যে বাড়ি। বাড়িতে বলি প্র্যাকটিকাল ক্লাস ছিল। ব্যস্,” জানালেন দেবাদৃতা। এটাও কিন্তু একটা ট্রেন্ড। অবশ্য দুপুরে পার্টি করার ট্রেন্ডটা নতুন নয়। বছর দু’য়েক আগেই শুরু হয়েছিল। এখন বাড়ির হ্যাপা সামলানোর জন্য এটাই সেরা রাস্তা দেবাদৃতা, মনীষা বা অনুভবদের। বাড়িতে পারমিশনের ঝক্কি নেই। চান্স নেই দেরি করে বাড়িতে ঢুকে কেস খাওয়ারও। দরকার শুধু দেবাদৃতার মতো বিশ্বাসযোগ্য কোনও গুল।
কিন্তু যদি রাতেই যেতে হয় নাইট ক্লাব। অর্ক বা সৌম্যদীপের মতো মফস্সলের ‘পার্টি পিপল’দের ফিরতে অসুবিধা হয় না?
“হ্যা।ঁ তা তো একটু হয়ই। কিন্তু ব্যান্ড নাইট তো আটটা-ন’টার মধ্যে শুরু হয়ে যায়। শেষও হয়ে যায় দশটার মধ্যে। মেট্রো করে ফিরে আসতে কোনও অসুবিধাই নেই। আর মেট্রো মিস করলে বন্ধুদের মেস তো আছেই,” সৌম্যদীপ জানালেন।
কিন্তু নাইট ক্লাবের এই টানটা কীসের? লাঞ্চ না খেয়ে জমানো টাকা বা টিউশন পড়ানোর টাকা নাইট ক্লাবে ঢেলে আসা কীসের তাগিদে? যেখানে রাতে বাড়ি ফিরতেও হাজারো সমস্যা? শুধুই কি পিয়ার প্রেশার?
“ওই চাপটা তো আছেই। বন্ধুরা যা করছে তুমি না করলে তো কাস্ট অ্যাওয়ে হয়ে পড়বে। নিজের কুল ফ্যাক্টরটা তো বাদ দেওয়া যাবে না! আর একটা ব্যাপার আছে, সেটা হল এজ গ্রুপ। মধ্যবিত্ত হোক কি ধনী, আদতে তো জেন ওয়াই, নতুন জিনিসের প্রতি একটা টান তো থাকবেই। নাইট ক্লাব সেই টানেরই একটা পার্ট,” রীতিমত সমর্থনের সুর মনস্তত্ত্ববিদ ড. জয়রঞ্জন রামের গলায়, “আর টিউশন করে নাইট ক্লাবে যাওয়াতে খারাপ তো কিছু নেই, বরং ভালই। অসৎ পথে তো আর টাকাটা জোগাড় করছে না।” |
|
|
|
|
|