হুল্লোড়
হাতে ট্যাটু নেই বল আছে
ল্প-স্বল্প বাংলা বুঝতে পারেন। কিন্তু একেবারেই বলতে পারেন না। হিন্দিটাও কেমন যেন। মিশে থাকে মোরাদাবাদের চোরা টান।
উত্তমকুমারের নাম শোনেননি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বা দেব কে, জিজ্ঞেস করলে চোখ কপালে ওঠে। থতমত গলায় জবাব আসে, “ভাল অভিনয় করেন নিশ্চয়ই। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভাল হলেই ভাল। আসলে সিনেমা একেবারেই দেখি না!”
বাংলার সংস্কৃতি-সাহিত্য নিয়ে সম্যক ধারণা নেই বিশেষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটা শোনা আছে, ওই পর্যন্ত। তবে লুচি-তরকারিটা বেশ ভাল লাগে। কষা মাটন পেলে কথাই নেই।
তিনি বাঙালি নন, তবু বাংলার বটে। বিশ্বাস করেন গম্ভীর-মন্ত্রে। নাইট অধিনায়কের কায়দায় বলে দিতে পারেন, ‘‘আমিও আপনাদেরই। ঘরের ছেলে।’’ বাংলা, বাঙালির ভাবাবেগ নিয়ে যিনি অকপট। “ছ’বছর ধরে আছি এখানে। বেঙ্গল কী দেয়নি আমাকে? গম্ভীরের মতো আমিও তাই এখানকারই, কলকাতার। যত দিন খেলব, বাংলার হয়েই খেলব।” যিনি ফেসবুক-টুইটারের পৃথিবীতে না থেকেও রাতারাতি হয়ে যেতে পারেন শহরের ‘ইয়ুথ আইকন’।
কে তিনি? পাকিস্তান সিরিজ থেকে যাঁরা মন দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটকে দেখেছেন, শ্যামলা, লম্বাচওড়া চেহারাটা নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে। স্মুথ অ্যাকশনে তাঁর সুইং ঘায়েল করেছে একের পর এক ব্যাটসম্যানকে, আর বাঙালির মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়েছে আফসোস, “ইস্স..যদি এর সঙ্গে দিন্দাকেও খেলাত...একসঙ্গে দু’জন বাংলার পেসার..।” নাম এর পর বলে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন পড়ে না, নাম সামি আহমেদ। কিন্তু গোড়াতেই ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া দরকার।
সামি আহমেদ নন। মহম্মদ সামি!
কী করা যাবে, বাংলা যেমন তাঁর দুনিয়া পাল্টে দিয়েছে, নামটাও দিয়েছে বদলে! ‘আহমেদ’ শব্দটা কোনও কালেই তাঁর নামের সঙ্গে ছিল না। মহম্মদ সামি বলেই তাঁকে লোকে জানে মোরাদাবাদে। কিন্তু সিএবি-তে নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় যে বিভ্রাট হয়েছিল, সেটা আজও ঠিক হয়নি। শোনা যায়, তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু নাভেদ আহমেদের (ইনিও এক জন ক্রিকেটার) সঙ্গে একই সময়ে নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় গণ্ডগোলটা হয়। নাভেদের নামের শেষাংশ বসে যায় সামির পাশে। আজ সামির দু’টো পাসপোর্ট। দু’টো নামে। দেশের হয়ে খেলেও তো চলেছেন ভুল নামে।

আশ্চর্য শোনাচ্ছে? শোনাক। সামির জীবনও তো কম আশ্চর্যের নয়। যে প্রজন্মের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ বিরাট কোহলি, যে প্রজন্মের কাছে গভীর রাতে নাইটক্লাবে যাওয়া ‘দুধুভাতু’, সেই ‘জেন ওয়াই’-এর দুনিয়ায় সামিও আছেন। ভুল হল। আছেন, কিন্তু থেকেও নেই। নইলে কেনই বা ইন্ডিয়া ক্রিকেটার হয়েও এই বাজারে তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল থাকে না? কেনই বা নাইটক্লাবের নাম শুনলে আঁতকে উঠে বলে ফেলেন, “ওরে বাবা, আমি ও সবে নেই।”
মহম্মদ সামি টাকাটাও চেনেন না!
কত অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প লুকিয়ে আছে সামির জীবনে। সাত বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন যখন, ম্যাচপিছু পেতেন মোটে সাড়ে সাতশো টাকা! তখন সামি ডালহৌসি ক্লাবে। পরের বছর টাউন-কর্তা দেবব্রত দাস নিজের ক্লাবে নিয়ে আসেন। ময়দানে যিনি সামির ‘গুরু’ বলে পরিচিত। টাউনে প্রথম দিকে সামি পেতেন দিনে পঁচাত্তর টাকা! কিন্তু অভিযোগ দূরে থাক, কোনও দিন নাকি টাকা-পয়সা নিয়ে টুঁ শব্দও বেরোয়নি সামির মুখ থেকে। খুব দরকারে টাউন-কর্তার সামনে প্রবল সঙ্কোচে দাঁড়িয়ে থাকতেন। চাপাচাপি করলে কোনও মতে উত্তর আসত, “কুছ প্যায়সা মিলেগা? ঘর ভেজনা হ্যায়!” এমনকী এ-ও বলেছেন, “মুঝে পেমেন্ট নেহি চাহিয়ে। সিরফ বেঙ্গল খিলা দো।” সিগারেট, মদ কোনও কিছুর নেশা নেই। শখ বলতে একটু-আধটু ভাল জামাকাপড় কেনা। ব্যস।
আইপিএলের বাজারেও কী ভাবে সম্ভব এত সংযম? এত লো প্রোফাইল রেখে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা?
উত্তর দিতে দু’মিনিট ভাবলেন না। “দেখুন, সবার জীবনদর্শন এক হয় না। কখনওই ভাবিনি টাকার জন্য ক্রিকেট খেলব। খেলেছি ভেতরের আবেগ থেকে। প্যাশন থেকে। আমি জানতাম যদি ক্রিকেটটা ঠিক করে খেলতে পারি, তা হলে টাকা এমনিই আসবে,” বলতে বলতে একটু থামেন সামি। উদ্দাম আধুনিকতার স্রোতেও যিনি সনাতনী। নইলে আর বলবেন কেন, “জিজ্ঞেস করছিলেন না কেন আমার টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই, কেন নাইট ক্লাবে যাই না? সময় নেই। তা ছাড়া সবাই সব কিছু পারে না। আমিও তেমন হাতে ট্যাটু করতে পারি না। আমাকে দিয়ে একটাই কাজ হবে। ক্রিকেটটা হবে। তাই বাকি সব ভুলে মন দিয়ে ওটাই করি। আমি নিজের শেকড়টাকে জানি। চিনি।”
ঠিকই। শেকড়কে চেনেন বলেই ক্রিকেট-আকাশ ছোঁয়ার পরেও তাঁর পা দুটো থাকে মাটিতে। ভারতীয় দলে ঢুকে যাওয়ার পরেও ময়দানের পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে যায়। নাভেদ আহমেদ যেমন। গড়চা রোডের মেসে একটা সময় কম্বল ভাগাভাগি করতেন সামির সঙ্গে। বর্তমানে সামির ঠিকানা মোহনবাগানের দেওয়া হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের মেস। নাভেদের নয়। কিন্তু সম্পর্কে কোনও কাঁটাতারের খোঁজ নেই। বরং নাভেদ বলছিলেন, “ইন্ডিয়া খেলছে সেটা কখনও জাহির করতে দেখলাম না। সামি খুব সহজ ছেলে। সোজা, সরল। দু’টো জিনিস বোঝে। ক্রিকেট আর ঘোরা। এক বার মোরাদাবাদে ওর বাড়ি গিয়েছিলাম। আমাকে টানাহ্যাঁচড়া করে সোজা নৈনিতাল নিয়ে উপস্থিত হল!”
এক পলকে
• গোড়ায় গলদ। আসল নাম মহম্মদ সামি। রেজিস্ট্রেশনের ভুলে সামি আহমেদ।
• বাঙালি নন, কিন্তু বাঙালির প্রিয় লুচি-তরকারি পেলে ছাড়তে পারেন না। পছন্দ কষা মাংস, আরসালানের বিরিয়ানি।
• সিনেমায় বিশেষ মন নেই। তবে পছন্দের নায়ক অমিতাভ বচ্চন।
• ইংরেজি গান শোনেন না। হিন্দি মোটামুটি সবই।
• ক্রিকেট-আইডলের নাম ডেল স্টেইন। ফাঁক পেলেই দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারের সিডি নিয়ে বসে পড়েন।
• বাইশ গজের বাইরে পছন্দ কচিকাঁচাদের সঙ্গে গলি ক্রিকেট।
• নাইটক্লাব-ফেসবুক-টুইটারের দুনিয়া তাঁর কাছে অন্য গ্রহ।
শেকড়টা জানেন বলেই ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটা কোনও দিনই আবছা হয়ে যায় না নিজ-অভিধানে। আত্মীয়ের বিয়ে মিটিয়ে গাড়িতে ‘মোরাদাবাদ টু দিল্লি’, তার পর ট্রেনে ‘দিল্লি টু কলকাতা’ করে সাত সকালে ম্যাচে নেমে পড়ার নিদর্শন আছে। জিজ্ঞেস করলে পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, “করব না কেন? কলকাতায় এসেছিলাম দেশের হয়ে খেলব বলে।” শেকড়টা ভোলেননি বলেই বান্ধবী-টান্ধবী নয়, ম্যাচের আগে-পরে নিয়ম করে সামির ফোন যায় বাড়িতে। বাবা-মা-র কাছে। রোজ জানতে হবে, বাড়িতে কে কেমন আছে। আদরের ভাই ‘ছোটু’ কেমন আছে। পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব সামির কাছে ঠিক কতটা জানতে চান? বেশি পিছতে হবে না। এ বারেরই রঞ্জিতে পঞ্জাব ম্যাচ খেলতে গিয়ে চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সামি। পিঠে একটা ছোট সমস্যা আছে। ব্যাক স্প্যাজম। বাড়ি থেকে তাই আয়ুর্বেদিক তেল আনার কথা ছিল সামির বাবার।
সেই তেল হাতে পেয়ে তবে চণ্ডীগড় ছেড়েছেন। পরিবারের বিশ্বাস সামির ‘ধর্ম’।
“অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। যখন আমার কেউ ছিল না, আমার পরিবার ছিল। অনেকে তুকতাক করে ম্যাচের আগে। আমার ও সব নেই। কিন্তু ম্যাচের আগে নিয়ম করে বাড়িতে ফোন করি,” বলছিলেন সামি। কী পান ফোন করে? “কনফিডেন্স। ফোনে বাবা-মা আমাকে বলেন বেটা তু ঘবড়া মত। খারাপ কিছু হলেও আমরা তোর পাশে আছি, ছিলাম, থাকব। কিছু হলে সোজা বাড়ি চলে আসবি।”
বাড়ি যান, তবে ন’মাসে-ছ’মাসে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আবির্ভাবের পর গিয়েছিলেন। তখন মোরাদাবাদ থেকে নিজের গ্রাম সাহসপুরের অল্প দূরত্ব পেরতে লেগেছিল ঝাড়া তিন ঘণ্টা। গোটা রাস্তা ভিড়ে ভিড়াক্কার। ধাক্কাধাক্কি। সামির গাড়ি আটকে ডিজের লাইভ পারফরম্যান্স। ছেলেবেলার কোচ বদিরুদ্দিনের সঙ্গেও ভাল করে কথা বলতে পারেননি। যাঁর কাছে একুশ-একুশ বিয়াল্লিশ কিলোমিটার যাতায়াত করতেন ক্রিকেটপাঠের লক্ষ্যে। রোজ।
“পেছনে ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবলে অবাকই লাগে একটু। তবু বলব, এখনও কিছুই করিনি। সবে জার্সিটা পেয়েছি। বহু দূর যাওয়া বাকি,” বাংলা পেসার বলেন যখন, অতিরিক্ত বিনয় মনে হয় না এতটুকু। বরং সঙ্কল্পের ঠিকানাটা পাওয়া যায়।
...একটা লাল বল। ‘আউটসাইড দ্য অফ স্টাম্প’ লাইন। সুইংয়ের বিষ মিশিয়ে বলটাকে ছেড়ে দেওয়া। সঙ্গে মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়া ময়দানি ‘গুরু’-র জয়মন্ত্র...
‘ফাঁড় দে বেটা!’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.