পারিবারিক বিবাদে পক্ষ নিয়ে এক মহিলার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে মারধর ও খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠল দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তৃণমূল কংগ্রেসের এক ব্লক সভাপতি ও তাঁর দুই সঙ্গীর বিরুদ্ধে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার ও সোনারপুর থানায় গত ৮ জানুয়ারি বোড়াল ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি কানাই কর্মকার ও তাঁর দুই সহযোগী দুলু ঘোষাল এবং গোপাল চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন বছর পঞ্চাশের বিধবা কনিকা বিশ্বাস। অভিযোগ করেছেন রাজ্য মহিলা কমিশন, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়কের অফিস ও তৃণমূল কংগ্রেসের সদর দফতরে। গত ১৬ জানুয়ারি মহিলা কমিশনে করা অভিযোগেও তিনি লিখেছেন, “শাসকদলের নেতাদের অত্যাচার থেকে আমাকে বাঁচান, যাতে আমি সুস্থ ভাবে বসবাস করতে পারি।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠি এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন, “মহিলার কোনও ক্ষতি যাতে কেউ করতে না পারে সেটা আমরা দেখছি।”
কণিকাদেবীর অভিযোগ, “৮ জানুয়ারি কানাই কর্মকার, দুলুবাবু ও গোপালবাবু এসে অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে আমার দু গালে থাপ্পড় মারে। চুলের মুঠি ধরে শাসায়। বলে, আগামী ২০ তারিখ, রবিবার বোড়ালের রক্ষিতের মোড়ে
|
কানাই কর্মকার |
|
কণিকা বিশ্বাস |
তৃণমূলের পার্টি অফিসে গিয়ে আমাকে জমি ও বাড়ি সংক্রান্ত সব কাগজপত্র দিয়ে আসতে হবে এবং বাড়ি ছেড়ে দেব, এমন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তা না হলে ওরা ৫০০ ছেলে পাঠিয়ে আমাকে বাঁশ পেটা করে মেরে ফেলবে।”
বছরখানেক আগে স্বামী মারা যাওয়ার পরে কণিকাদেবী এখন বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। আপাতত প্রতিটি মুহূর্ত আবার আক্রমণের আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, “রাজনৈতিক দলের নেতারা কি ক্ষমতাবলে যে কোনও পারিবারিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে? যে কোনও বাড়িতে ঢুকে মেয়ে-বৌয়ের গায়ে হাত তুলতে পারে? অত্যাচারের সামনে আমাদের এই ভাবে মাথা নোয়াতে হবে?”
রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে বোড়ালের দ্বিজের হাট ব্রিকফিল্ড রোডে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের দখল করা জমির উপর কয়েকটি পরিবারের বাস। এঁদেরই এক জন কণিকাদেবী। তাঁর শ্বশুরমশাই প্রায় ৪০ বছর আগে এই জমিতে থাকতে শুরু করেন। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর সূত্রে খবর, জমি ও বাড়ির পাট্টা সরকারের থেকে পাওয়ার জন্য কণিকাদেবী ও অন্যান্য দখলদারেরা তাদের কাছে আবেদন করেছেন, যা এখনও বিবেচনাধীন রয়েছে। কণিকাদেবীর ভাসুরদের সঙ্গে ওই জমি ও বাড়ি নিয়ে বিবাদ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমস্যা শুরু হয় যখন তৃণমূলের একাধিক নেতা এর মধ্যে ঢুকে পড়েন।
কণিকাদেবী ও তাঁর কয়েক জন প্রতিবেশীর অভিযোগ, নেতাদের হুমকি শুরু হয়েছিল নভেম্বর মাস থেকেই। গত ৮ জানুয়ারি তা চরমে পৌঁছয়। তাঁদের অভিযোগ, কণিকাদেবীর ভাসুর তপন বিশ্বাসের সঙ্গে বোড়ালের তৃণমূল সভাপতি কানাইবাবু ও অন্য কয়েক জন তৃণমূল কর্মী ওই দিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ কণিকাদেবীর বাড়ি যান। কানাইবাবু কণিকাদেবীকে মারধর করেন ও খুন করে ফেলার হুমকি দেন।
কানাইবাবুর বক্তব্য, “ওই মহিলার ভাসুরেরা আমাদের যেতে বলেছিলেন। মহিলা ওঁদের জমি দখল করে রয়েছেন। আমি তাই দুলু আর গোপালকে নিয়ে ওঁকে সতর্ক করতে গিয়েছিলাম।” কানাইবাবুকে প্রশ্ন করা হয়, জমি তো এখনও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের। সেটা যে মহিলার ভাসুরদের, সেটা দাবি করছেন কী করে? কানাইবাবুর জবাব, “জমি ভাসুরদেরই পাইয়ে দেব। আমরা সব পারি। ওই মহিলার এত বড় সাহস যে আমার নামে নালিশ করেছে, এ বার ওর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেব। পাড়াছাড়া করব।”
প্রশ্ন উঠেছে, পারিবারিক বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক দল কেন মাথা ঘামাবে? কানাইবাবুর জবাব, “আলবাৎ ঘামাবে। যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক দল তা-ই করেছে। তা ছাড়া, ওই মহিলার চরিত্র খারাপ। ও পাড়ায় থাকলে পাড়াটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
কণিকাদেবীকে মারধর ও প্রাণে মারার হুমকি দেওয়ার বিষয়ে কানাইবাবু বলেন, “আমি যে মেরেছি, হুমকি দিয়েছি সেটা কে বলবে? কার এত বড় ক্ষমতা আছে? সাক্ষী কোথায়?” কণিকাদেবীর প্রতিবেশী অমরনাথ পাল, তাঁর স্ত্রী বেবি পাল ও কিশোরী কন্যা অমৃতা কিন্তু বলেছেন, “আমাদের সামনে কানাইবাবু মাসিমাকে চড় মেরেছেন, মুখের উপর আঙুল তুলে ৫০০ ছেলে পাঠিয়ে খুনের হুমকি দিয়েছেন। আমরা মুখ খুলছি বলে হয়তো আমাদেরও বিপদ হবে। কিন্তু সবাই চুপ করে থাকলে তো কেউ আর ন্যায় পাবে না।”
সব শুনে তৃণমূলের যাদবপুর এলাকার সাংসদ কবীর সুমনের উক্তি, “একের পর এক অভিযোগ কানে আসছে। আমি ভয় পাচ্ছি, অত্যন্ত সন্ত্রস্ত বোধ করছি। বিশেষ করে বাড়ি-জমির মালিকানা নিয়ে এই এলাকায় ভয়ঙ্কর সমস্যা দেখা দিয়েছে। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা, তৃণমূলের মদতপুষ্ট ক্লাব গিয়ে শাসাচ্ছে, পয়সা আদায় করছে। আমার দল তো আমার পাশে নেই, তাই জনপ্রতিনিধি হিসাবে আমার যাবতীয় কথা বলা, প্রতিবাদ তাদের কাছে নিরর্থক হয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত অস্বাভাবিক একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে।” আর দক্ষিণ ২৪ পরগনার তৃণমূল সভাপতি তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “কানাই কর্মকার নামে কাউকে মনে করতে পারছি না। তিনি কী করে বেড়াচ্ছেন সে খবরও আমার কাছে নেই। তাই কোনও মন্তব্য করব না।” |