নিধু ডাক্তারের ভুতুড়ে চিকিৎসা
হাড়-কাঁপানো শীতের রাত। সনাতনের হাঁকডাক শুনে বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে প্রতিবেশীরা। তাদের মধ্যে কেউ এক জন পরামর্শ দিল, ‘রাত প্রায় দশটা বাজে। এত রাতে নিধু ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে তুমি পাবে না সনাতন। গেলে ওর কাছেই যাও।’
শুনে রে রে করে উঠল আর এক জন, ‘নিধু ডাক্তারকে নিয়ে কানাঘুষোর ব্যাপারটা ভুলে গেলেন আপনারা! ডাক্তার বলেন বটে লোকের সুবিধার জন্যই রাত বারোটা পর্যন্ত উনি চেম্বার খুলে রাখেন। কিন্তু আদতে কেসটা নাকি ভিন্ন। উনি চেম্বার খুলে রাখেন ভূতেদের জন্য! রাত দশটার পর ভূতেরা নাকি ওঁর কাছে চিকিৎসা করাতে আসে!’
পড়শির কথায় গা-টা ছমছম করে উঠলেও সংজ্ঞাহীন ছেলের কথা ভেবে কথাটাকে উড়িয়ে দিল সনাতন। ঘর থেকে সাইকেল বার করতে করতে বলল, ‘ভূত-প্রেত যার চিকিৎসাই করুক না কেন, এত রাতে ডাক্তার যে পাওয়া যাচ্ছে, এই আমার বাপের ভাগ্যি।’ কথাটা বলেই সনাতন আর দাঁড়াল না। সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিল।
সনাতনের বাড়ি থেকে সিকি মাইলটাক দূরে নিধু বিশ্বাসের ‘বিশ্বাস হোমিও হল’। চেম্বারে ডাক্তারবাবু এক মনে হোমিওপ্যাথির পুরিয়া তৈরিতে ব্যস্ত। চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে উল্টো দিকের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে এক জন রোগী। সনাতনের আর তর সইল না। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করেই হুড়মুড় করে নিধু ডাক্তারের টেবিলের সামনে গিয়ে হাজির হল। আকুল স্বরে বলে উঠল, ‘আমার মা-মরা ছেলেটাকে আপনি বাঁচান ডাক্তারবাবু। আজ দুপুর থেকে ওকে একটা অদ্ভুত রোগে পেয়েছে। যে ছেলে হিসাব করে খায়, খাওয়ার সময় হাজার গণ্ডা বাছবিচার করে, সে হঠাৎ রাক্ষসের মতো যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে! দুপুরবেলা দেখি এক গামলা দুধ, এক থালা ভাত, চার খানা সেদ্ধ ডিম আর এক কড়াই শুটকি মাছের তরকারি গোগ্রাসে খেয়ে নিল! তার পর সন্ধ্যা হতেই আর এক বায়নাক্কা। বাবুর আস্ত একটা ইলিশ মাছ চাই, ভাজা খাবে! মেজাজ এমন টং হয়ে গেল যে দিলাম কষে এক চড়। ব্যস, তাতেই বিপত্তি, চোখ উল্টে ভিরমি খেল ছেলে!’
সনাতন থামলে চোখ পিটপিট করলেন নিধু ডাক্তার, ‘লক্ষণ শুনে মনে হচ্ছে ‘খাই খাই’ রোগ! তবে জ্ঞানটা আগে ফেরানো দরকার। তার পর আসল চিকিৎসা। তুমি বসো, ওষুধটা আমি তৈরি করে দিচ্ছি।’
সনাতন হাতজোড় করল, ‘রাতবিরেত বলে কথা, ওষুধে কাজ না হলে আতান্তরে পড়ব। আপনি একটু চলুন ডাক্তারবাবু, প্লিজ!’
ছবি: দেবাশীষ দেব
তা কী করে হয়। নিধু ডাক্তার ভুরু কোঁচকালেন, ‘রাত তো সবে দশটা। এর পর আরও কত রোগী আসবে। তাদের না দেখে...! ঠিক আছে ওষুধটা নিয়ে গিয়ে ছেলেকে খাওয়াও তো। কাজ না হলে আধ ঘণ্টা বাদে আবার এসো। তখন নিশ্চয় যাব আমি।’
অগত্যা কী আর করা। ওষুধ নিয়ে বেজার মুখেই ফিরে গেল সনাতন।
সনাতন সাইকেল হাঁকিয়ে চলে যাওয়ার পরক্ষণেই চাদর জড়ানো লোকটা নড়েচড়ে বসল। গলা খাঁকরি দিয়ে বলে উঠল, ‘ভদ্রলোককে ফালতু দৌড় করালেন ডাক্তারবাবু। আপনার ওই ওষুধে কোনও কাজই হবে না!’
শুনেই খেপে লাল নিধু ডাক্তার, ‘ভূত আছিস ভুতের মতো থাক! ডাক্তারির তুই বুঝিসটা কী শুনি?’
ডাক্তারি না বুঝলে কী হবে, ভদ্রলোকের ছেলের রোগটা কী, তা আমি জানি।
তুই জানিস! ডাক্তারবাবু বিষম খেলেন, ‘তা বল দেখি কী রোগ?’
ওকে ভুতে ধরেছে! পেটুক মদনার কাণ্ড এটা!
নিধু ডাক্তার হাঁ, ‘তুই জানলি কী করে?’
ও তো আমারই স্যাঙাত। শ্মশানে একসঙ্গে আড্ডা মারি। গত কাল রাতেই তো কথায় কথায় আমাকে বলছিল, ‘কত দিন ইলিশ মাছ খাই না। ক-ত-দি-ন! ভাবছি কারও ঘাড়ে চেপে শখটা এ বার মিটিয়েই নেব...!
মদনাই যদি হবে, তা হলে জ্ঞান হারানোর মানেটা কী!
সব মদনার ফিচলেমি। ব্যাটা নাটক করছে!
তা হলে উপায়? ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন নিধু ডাক্তার।
পাঁচু ভূত ভাবল একটু, ‘আপনি এক কাজ করুন ডাক্তারবাবু, ভদ্রলোক এলে ওঁর সঙ্গে চলে যান। গিয়ে মদনাটাকে তাড়ান। বন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করা উচিত নয়, তবু আপনি বলেই দুটো সূত্র দিচ্ছি। এক, তেতো জিনিসের নাম শুনলেই মদনা ওয়াক তোলে, এমন ঘেন্না। আর দ্বিতীয়টা হল, আরশোলাকে যমের মতো ভয় পায়!’
হাঁপ ছাড়লেন নিধু ডাক্তার, ‘আমি বুঝে গিয়েছি। ব্যস ব্যস, এতেই চলবে!’
ওষুধ নিয়ে পাঁচু ভূত বিদায় নেওয়ার খানিক বাদেই সনাতন এসে হাজির। এসেই পাংশু মুখে বলল, ‘ছেলের জ্ঞান ফিরল না ডাক্তারবাবু। দয়া করে এ বার আপনি চলুন।’ কথা দিয়েছেন সুতরাং যেতেই হবে। অগত্যা চেম্বার বন্ধ করে সনাতনের সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে বসলেন। কাঁধের ঝোলায় হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স। সনাতনের বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন ভিড়ে গিজগিজ করছে বাড়ি। নিধু ডাক্তার আর দেরি না করে রোগীর ঘর থেকে সবাইকে বাইরে বার করে দিলেন। দরজায় লাগিয়ে দিলেন ছিটকিনি। তার পর সনাতনের অচেতন ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, নিমপাতা, নিসিন্দাপাতা, উচ্ছে, করলা, চিরতা, কালমেঘ...! লম্বা তালিকাটা বার কয়েক আউরাতেই প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেল। ওয়াক তুলে বমি করল সনাতনের ছেলে। কিন্তু বমি করা সত্ত্বেও রোগী চোখ মেলছে না দেখে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে সনাতনকে বললেন, ‘গোটা সাতেক আরশোলা চাই আমার। যেখান থেকে পার জোগাড় করে নিয়ে এসো।’
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আরশোলা! সনাতনের ভিরমি খাওয়ার দশা, ‘ছেলেটাকে আরশোলা খাওয়াবেন নাকি?’
রোগ সারাতে গেলে দরকার পড়লে তাই খাওয়াব! দেরি কোরো না, কুইক!
উপস্থিত লোকজনের তৎপরতায় মিনিট দশেকের মধ্যেই সাতখানা আরশোলা জোগাড় হয়ে গেল। আরশোলা ভর্তি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ঘরের দরজা আবার বন্ধ করলেন নিধু ডাক্তার। প্রথম আরশোলাটাকে সনাতনের ছেলের গায়ের উপর ছেড়ে দিতেই ম্যাজিক ঘটল যেন। ইলেকট্রিকের শক খাওয়ার মতো কেঁপে উঠল ছেলেটা। প্রথমটার পর দ্বিতীয়টা, তার পর তৃতীয়টা, এই ভাবে পর পর কয়েকটা ছাড়তেই ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। তেলাপোকাগুলি যত গা বায় ততই ছেলেটার শরীর দুমড়ে মুচড়ে যায়! শেষে সপ্তম আরশোলাটা গায়ে পড়তেই বিছানা ছেড়ে কয়েক হাত শূন্যে উঠে পরক্ষণেই আবার ধপ করে নীচে পড়ল সনাতনের ছেলে! আর তার পরেই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো চোখ মেলে তাকাল!
খানিক বাদে দরজার ছিটকিনি খুলে হাই তুললেন নিধু ডাক্তার, ‘আর কোনও ভয় নেই। ছেলে তোমার ভাল হয়ে গিয়েছে সনাতন!’
ডাক্তারের কথায় হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল সনাতন। ছেলেকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখে ওর আনন্দ আর ধরে না। ছলছল চোখে বলে উঠল, ‘আপনি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি ডাক্তারবাবু। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.