শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান
আজকের হিরো: ইন্ডিপেন্ডেন্ট রেভোলিউশনারি আর্ট
কই শিল্পীকে নিয়ে পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে দুটি দৃশ্য।
প্রথম দৃশ্য পঞ্চাশের আমেরিকায়। প্রেসিডেন্ট ম্যাককার্থির শাসন, সর্বত্র কমিউনিজ্মের ভূত দেখছেন তিনি। সেই সময়েই ডেট্রয়েটে ফোর্ডের মোটর কারখানায় লাইন দিয়ে দাঁড়াল শ্রমিকরা। হাতে প্ল্যাকার্ড, ‘শিল্পীর বক্তব্য সমর্থন করি না। কিন্তু শিল্পকে বাঁচাতে চাই।’ ওই কারখানাতেই মেক্সিকোর শিল্পী ডিয়েগো রিভেরা ১৯৩০ সালে একটি ম্যুরাল বা দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন। ডিয়েগো মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, মেক্সিকোর ‘ন্যাশনাল প্যালেস’ থেকে শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট, আর্জেন্তিনার জাতীয় সংগ্রহশালা ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর আঁকা ম্যুরাল রয়েছে। ফোর্ড কোম্পানির মালিক এডসেল ফোর্ড এই শিল্পীর অন্যতম সমঝদার। তিরিশের দশকে তিনিই ওই ছবির বরাত দিয়েছিলেন। শ্রমিকদের আশঙ্কা, কমিউনিজ্ম-বিরোধী সরকার মুর্যালটা নষ্ট করে দেবে।
ধনকুবের রকফেলার এবং তাঁর স্ত্রীও রিভেরার ছবি পছন্দ করতেন। তাঁরা নিউ ইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’ বা মোমা-য় ম্যুরাল আঁকার জন্য রিভেরাকে নিয়ে আসেন। ১৯৩১ সালে মোমা-র জন্য রিইনফোর্সড সিমেন্টের ওপর গ্যালভানাইজ্ড স্টিলের ফ্রেমে ‘আপরাইজিং’ নামে একটি ম্যুরাল তৈরি করলেন শিল্পী। তলোয়ার বের করে শিশু কোলে এক নারীকে হঠিয়ে শ্রমিকদের মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় পুলিশ। শিশু চেঁচায়, নারীটি পুলিশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি মাত্র দেড় বছর আগের। মোমা-য় রিভেরার এগজিবিশনের ৮০ বছর পূর্তিতে তাঁর দেওয়ালচিত্রের প্রদর্শনী। রয়েছে ‘আপরাইজিং’ও। ম্যাককার্থি-জমানা আজ স্মৃতি। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ। বাতাসে ‘রাজনৈতিক সহনশীলতা’, ‘সংস্কৃতির বহুত্ববাদ’ ইত্যাদি ভাল ভাল কথা। সেই সময়েই ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের কল্যাণে জনা কয়েক তরুণ-তরুণী মোমা-র অনতিদূরে ম্যানহাটানের রাস্তায় ভিড় জমিয়ে দিল, ‘আপরাইজিং’ ছবির মতোই পুলিশ হিঁচড়ে তাদের উঠিয়ে দিল। দুনিয়া বদলায় না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগের বছর, ১৯৩৮ সালে মেক্সিকোয় বসে এই ডিয়েগো রিভেরা আর আঁদ্রে ব্রেতঁ লিখেছিলেন ‘ম্যানিফেস্টো ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট রেভোলিউশনারি আর্ট’। স্বাধীন বিপ্লব। কেন না, হিটলারের জার্মানি এবং স্তালিনের সোভিয়েত দুই জমানাকেই সমান শ্বাসরোধকারী বলে বর্ণনা করে এই ম্যানিফেস্টো। ‘যে শিল্পীরা স্বাধীনতার সমর্থনে কথা বলতেন, হিটলারের জমানায় তাঁরা কেউ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, কেউ তুলি কলম নিয়ে ওই একনায়কতন্ত্রের ভৃত্যে পর্যবাসিত হয়েছেন। তাঁদের কাজ, ওই জমানাকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরা।’ এই অবধি লিখেই থেমে গেল না ম্যানিফেস্টো। পরের বাক্য: ‘একই ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নেও।... সে দেশের একনায়কতন্ত্র তথাকথিত কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে অন্য দেশেও খবরদারির চেষ্টা করছে, প্রতিটি আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে আজ গভীর বিষাদ।’
১৯৩৮ সালে মেক্সিকোয় বসে যে ম্যানিফেস্টো হিটলার এবং স্তালিনকে একাসনে বসায়, তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে সন্দেহ নেই, ঠিকই। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায়? প্রথমত, ম্যানিফেস্টো বারংবার একনায়কতন্ত্রে শিল্পীদের দুর্দশার কথা বলে। দ্বিতীয়ত, দুই শিল্পীর লেখা ম্যানিফেস্টো শেষ লাইনে জানায়, ‘শিল্পের স্বাধীনতা বিপ্লবের জন্য। বিপ্লবশিল্পের পূর্ণ মুক্তির জন্য।’ বিপ্লব শব্দটি এখানে শুধু আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কথা বলে না। শুধু প্রগতির কথা বলে না। বরং বিপ্লবের সঙ্গে শিল্পের মুক্তি, শিল্পীর স্বাধীনতা একাকার।
আরও আশ্চর্য, ব্রেতঁ আর রিভেরার স্বাক্ষরিত এই ম্যানিফেস্টোয় তৃতীয় এক ভদ্রলোকের অবদান আছে। ভদ্রলোক লাল ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু তখন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হয়ে মেক্সিকোয় রিভেরার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। রিভেরার স্ত্রী, চিত্রশিল্পী ফ্রিডা কাহ্লো-র সঙ্গে তাঁর অ্যাফেয়ার ছিল। ওই রুশ ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতেই ব্রেতঁ ফ্রান্স থেকে মেক্সিকো এসেছিলেন। অতঃপর তিন জনে বসে ম্যানিফেস্টো লেখা। কিন্তু ভদ্রলোক সই করেননি। তাঁর যুক্তি, শিল্পের ম্যানিফেস্টো, এখানে শিল্পীদেরই সই থাকুক। তাঁর মতো রাজনীতিবিদের স্বাক্ষর এখানে নিষ্প্রয়োজনীয়। ভদ্রলোকের নাম লিওন ট্রটস্কি। এক জন রাজনীতিবিদ শিল্পের ম্যানিফেস্টো লেখায় যোগ দিচ্ছেন, এবং তার পর শিল্পীদের আড়ালে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে দিচ্ছেন, এই ঘটনা আর কোনও ‘আর্ট ম্যানিফেস্টো’য় ঘটেনি।
ম্যানিফেস্টোয় যে ট্রটস্কির হাত কতখানি, পরিষ্কার চতুর্থ অনুচ্ছেদেই। স্তালিন-ট্রটস্কি সংঘাত আজও রুশ ইতিহাসে উল্লেখ্য পর্ব। ম্যানিফেস্টো জানায়, ‘নতুন সংস্কৃতির পথ প্রশস্ত করতে সামাজিক বিপ্লব জরুরি, আমরা স্বীকার করি। তবু সোভিয়েত রাশিয়ার নয়া আমলাতন্ত্রকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের কাছে ওটি কমিউনিজ্মের প্রতীক নয়। বরং কমিউনিজ্মের বিপজ্জনক শত্রু।’
আরও চমকপ্রদ ঘটনা অন্যত্র। ট্রটস্কির লেখা ম্যানিফেস্টো পরিষ্কার জানায়, ‘বৌদ্ধিক সৃষ্টি ও শিল্পচর্চাকে যাঁরা হুকুম জারি করে তথাকথিত রাষ্ট্রীয় কারণে ব্যবহার করতে চাইবেন, আমরা তাঁদের বিপক্ষে।’ শিল্পকে বাঁচাতে নৈরাজ্যবাদের কথাও বলা হয়, ‘বিপ্লবের পর যদি সমাজতন্ত্রের নামে কোথাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জমা হতে থাকে, বৌদ্ধিক সৃষ্টিকে বাঁচাতে হবে। সে জন্য দরকারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে হবে।’ সমাজতন্ত্র, বিপ্লব শব্দগুলি বারবার ম্যানিফেস্টোয় এসেছে। ট্রটস্কির চিন্তাভাবনা ছিল। উপরন্তু ব্রেতঁ সুররিয়ালিস্ট হলেও সাম্যবাদে বিশ্বাসী, রিভেরা পার্টির সদস্য।
ম্যানিফেস্টোর ভবিতব্য? এক দশকও কাটেনি। ১৯৪০-এ মেক্সিকোর বাড়িতে স্তালিনের পাঠানো আততায়ীর হাতে খুন হলেন ট্রটস্কি। ব্রেতঁ বললেন, ম্যানিফেস্টোয় দুনিয়া জোড়া যে বিপ্লবের কথা বলা হয়েছিল, ঘটেনি। বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ট্রটস্কি।
সংঘ এ ভাবেই ভেঙে যায়! শুধু কিছু আঁকিবুকি হরফ আর স্বপ্ন নিয়ে ম্যানিফেস্টোরা থেকে যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.