পুরনো যুদ্ধ, নতুন ক্ষেত্র |
• • বামাকো (মালি) • মালি দেশটির খবর আমরা মোটেই রাখি না। তেমন কিছু ঘটেও না সেখানে, সুতরাং না-রাখাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সপ্তাহে যা কাণ্ড ঘটছে ওই দেশটিতে, এবং ওরই পাশাপাশি পশ্চিম আফ্রিকার আর এক দেশ আলজিরিয়ায়, যে নড়ে-চড়ে বসা ছাড়া উপায় নেই। মালিতে কিছু কাল আগেই আল কায়দা-প্রভাবিত জঙ্গি ইসলামি সংগঠন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট ত্রাওরে-কে ক্ষমতাহীন করে নিজেরা সরকার তৈরি করে, রাজধানী বামাকো দখল করে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংকট চলতে থাকে। নিহত হন কয়েকশো মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে সাগর পেরিয়ে উড়ে আসে ফরাসি বাহিনী, জঙ্গি ইসলামিদের দমন করে বশে আনার চেষ্টা করে। পুরনো ফরাসি উপনিবেশ বলেই যখন-তখন মালিকে এ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ফন্দিফিকির খোঁজে ফ্রান্স। গত সপ্তাহে ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দেয় বেশ কয়েকটি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশও, যার মধ্যে নাইজিরিয়া অন্যতম। পাশের ছবিটি নাইজিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী দেশ ছেড়ে মালিতে রওনা হওয়ার ঠিক আগেকার, বাহিনীর বন্দুকগুলি সহিংস অপেক্ষমাণ। মালির রক্তক্ষয় চলছে, হয়তো আরও কিছু দিন চলবে। এ দিকে ফরাসি নিয়ন্ত্রণের ফলে আল কায়দা বেকায়দা হওয়ামাত্র আর এক বিস্ফোরক ঘটনা ঘটল পাশের দেশ আলজিরিয়ায়। সেখানে একটি তৈল-শোধনাগার শিল্পক্ষেত্রে একসঙ্গে ষাটেরও বেশি ইউরোপীয় সাহেবকে পণবন্দি হিসেবে আটক করল আল কায়দার সহমর্মী সংগঠন ‘সিগনেটরিস অব ব্লাড’, রক্তশিকারীর দল মালিতে ফরাসি হস্তক্ষেপের পাল্টা চাল হিসেবে। হাড়-কাঁপানো হিংস্র নেতা মোকতার বেলমোকতার (ছবি) এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে ধারণা। আলজিরীয় সরকারের সঙ্গে জিহাদিদের সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই নিশ্চিত ভাবে নিহত জনা দুই জঙ্গি ও তিন জন বিদেশি বন্দি। সন্দেহ, আরও অনেককেই মেরে ফেলেছে জঙ্গিরা। বাকিদের মুক্ত করার জন্য বিশ্বময় কূটনৈতিক ব্যস্ততা চলছে এই মুহূর্তে।
মালি ও আলজিরিয়ার সাম্প্রতিক সংকটের গুরুত্ব বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে ব্রিটেন ও আমেরিকা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বারংবার ফোনালাপ করছেন। ফরাসি বাহিনীর প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন, কিন্তু সক্রিয় সাহায্য করতে তাঁরা নারাজ। মালির পণবন্দিদের মধ্যে রয়েছেন কয়েক জন ব্রিটিশ ও মার্কিনি। যে কোনও মূল্যে জীবিত অবস্থায় তাঁদের মুক্ত করে আনার জন্য দুই দেশনায়কই দেশবাসীর প্রবল চাপের মধ্যে।
কিন্তু সব ছাপিয়ে তাঁদের মূল উদ্বেগ অন্যত্র। উত্তর আফ্রিকার জঙ্গি ইসলাম কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়: গোটা পৃথিবীর পশ্চিম-বিরোধী ইসলামি মৌলবাদেরই একাংশ। ফলে সন্ত্রাস-বিরোধিতার ‘যুদ্ধ’ এ বার পশ্চিম এশিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকার দিকে ধাবিত হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। যুদ্ধক্ষেত্র কি পাল্টাচ্ছে? পশ্চিমি শক্তিগুলির কি দেরি হয়ে গেল এই সত্য অনুধাবন করতে? সত্য অনুধাবনের পর কী কর্তব্য এখন, কী ভাবেই বা দুই মহাদেশব্যাপী এই হিংসাশ্রয়ী জিহাদের মোকাবিলা করা? উত্তর সহজ নয়।
|
তা
হির-উল-কাদরি কে? এক কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। তিনি লাহৌরের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি, সেখানেই আইনের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মূলত সুফি দর্শন-কেন্দ্রিক একটি সংগঠন মিনহাজ-উল-কুরানের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১০ সালে তিনি সন্ত্রাসবাসের বিরুদ্ধে ফতোয়া (!) জারি করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং ভারতসহ বেশ কিছু দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান তাঁকে ‘শান্তির আন্তর্জাতিক দূত’ ইত্যাদি ভাল ভাল খেতাব দিয়েছে। আপাতত তিনি খবরে, কারণ গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন তিনি। ইসলামাবাদের জিন্নাহ্ স্ট্রিটে তাঁর সমর্থকদের নিয়ে তিনি অবস্থান বিক্ষোভ করছিলেন। সমর্থকরা খোলা রাস্তায়, এই শীতে বৃষ্টির মধ্যে। কাদরি বুলেটপ্রুফ ভ্যানে। তাঁর দাবি ছিল, শুক্রবারের মধ্যেই পাকিস্তান পিপলস পার্টির ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, নচেৎ শুক্রবার থেকে জনতার সরকার ক্ষমতা দখল করবে। অন্না হজারের ওপর এক কাঠি, বলতেই পারেন। এ দিকে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী রাজা পরভেজের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। বৃহস্পতিবার কাদরির সঙ্গে পাক সরকারের বৈঠক হল। তাঁর প্রায় কোনও দাবিই মানল না সরকার। এমনিতেই ১৬ মার্চ বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। মে মাসে নির্বাচন। সরকার জানিয়েছে, ১৬ মার্চের আগেই সরকার ভেঙে দেওয়া হবে, তবে কত আগে, কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচন হবে। কাদরি একেই নিজের জয় বলে দাবি করছেন। অন্য উপায়ও নেই তাঁর। পাকিস্তানের কোনও বিরোধী দল তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি, এমনকী প্রবল সরকার-বিরোধী ইমরান খানও নন। ‘বাইরের কেউ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ছিনতাই করে নিয়ে যাবে’, মানতে নারাজ বিরোধী পাক নেতারা। অর্থাৎ, এই শেষ বেলায় সরকার-বিরোধিতার মঞ্চে কাদরিকে জায়গা করে দিতে তাঁরা নিতান্ত অরাজি। স্বাভাবিক। অতএব কাদরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অন্তত আপাতত, হিমঘরে। |