১৮৯৭। ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস। গোপাললাল শীলের বাগানে কথা হচ্ছিল। বলছেন বিবেকানন্দ, শুনছেন শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী। আমেরিকা-ইংল্যান্ড ফেরত সন্ন্যাসী-যুবা বিবেকানন্দ, শিষ্যকে এদেশ-ওদেশ দুইয়ের তুলনা শোনাচ্ছেন। অযথা এদেশের সব কিছুকে ভাল বলার সংকীর্ণ হিঁদুয়ানি বিবেকানন্দের নেই। বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে তিনি, পারিবারিকতার সূত্রে সাংস্কৃতিক উদারতার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলেন। খাওয়াদাওয়া, গীতবাদ্য, এ সব ব্যাপারে দত্ত পরিবার রীতিমত কসমোপলিটান। দত্তদের তিন ছেলেই দেখার মতো। নরেন্দ্রনাথের খ্যাতি বেশি, তবে আর দুই ভাই মহেন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথও কিছু কম যান না। কেবল বাড়িতে নয়, পরে গুরুর কাছেও নরেন্দ্রনাথ যথেষ্ট প্রশ্রয় পেয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের কাছে ‘বোহেমিয়ান’ বিবেকানন্দ সম্বন্ধে অনেকে নালিশ করলেও ‘আচার্যদেব’ জানতেন নরেন অন্য ধাতের ছেলে, আধারটাই আলাদা। কানভাঙানো কথায় বড় একটা পাত্তা দিতেন না। কাজেই সংকীর্ণতার কোনও এক রকম ছাঁচে বিবেকানন্দকে ফেলা মুশকিল।
শিষ্যকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তুলনা শোনাতে গিয়ে কী বললেন বিবেকানন্দ? ‘‘মহারজোগুণসম্পন্ন তারা (পাশ্চাত্যবাসী) এখন ভোগের শেষ সীমায় উঠেছে
এখানে দু’রকম ভোগের ছবি। এক উৎকৃষ্ট ভোগ। সাহেবরা তা করতে জানে। কালিদাসের কালে সেই ভোগ ভারতীয়রাও করতে জানত বলে মনে হয়েছে বিবেকানন্দের। কালিদাসের কাল নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক, তবে মোটের ওপর তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের কবি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময় হয়তো ভোগের নিজস্ব রূপ গড়ে উঠেছিল। আর এক রকম হল অপকৃষ্ট ভোগ। সেই ভোগের দাস কারা? উদ্যোগহীন মানুষেরা। |
রুচিশীলতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিবেকানন্দ, ১৮৯৯ |
উনিশ শতকে যে কুলীন-পুরুষেরা খাতায় নাম লিখে বউয়ের হিসেব রাখত, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ এই কথা মনে রেখে নানা বউয়ের গর্ভে দায়িত্বহীন ভাবে অজস্র বাচ্চার জন্ম দিত, তারা তামসিক, এদেরই বিবেকানন্দ বলবেন অপকৃষ্ট ভোগী। তাদের কাছে ভোগ মানেই ‘যৌন-সম্বন্ধ’। বিবেকানন্দ ‘যৌন-সম্বন্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন অন্য একটি লেখায়। উদ্বোধন পত্রিকার প্রথম বর্ষের সম্পাদকীয়-সুলভ রচনায় বিবেকানন্দ পুরনো ভারতের নানা চেহারার কথা লিখেছিলেন। সেখানে ‘বর্ণভেদে যৌন-সম্বন্ধ মনূক্ত ধর্মের ন্যায়’-এর প্রসঙ্গ ছিল। আগামী ভারতে এ-সব বিবেকানন্দের কাম্য নয়। তিনি পিছন ফেরার বদলে সামনে তাকাতে নির্দেশ দিয়েছেন: ‘অনন্ত সম্মুখসম্প্রসারিত-দৃষ্টি; আর চাই আপাদমস্তক শিরায় শিরায় সঞ্চারকারী রজোগুণ’। মনে রাখতে হবে, যারা রাজসিক তারা ভাল ভাবে ভোগ করতে পারে। আর তামসিকদের ভোগ নিতান্ত যৌন-সম্বন্ধ। ছেঁড়া কাঁথা বদলাবার উদ্যম নেই, মুরোদ নেই, কিন্তু একপাল ভিখিরি, ক্রীতদাস বচ্ছর বচ্ছর জম্মাচ্ছে। আহা কী পৌরুষ! না, বিবেকানন্দ ‘আহা কী পৌরুষ’ লেখেননি, কিন্তু বোঝাতে চেয়েছেন।
এই অংশটুকু পড়ে একটু থমকে যায় মন। বিবেকানন্দ ৩৯ বছরে চলে গিয়েছিলেন। এই নাতিদীর্ঘ জীবনে দেশেবিদেশে ঘুরেছেন, বক্তৃতা দিয়ে মঠের জন্য অর্থ উপার্জন করেছেন, চলতে চলতে বলেছেন, লিখেছেন। কাজের শেষ নেই। সেই সব বলা-লেখার মধ্যে যুক্তিবাদীরা নানা স্ববিরোধ খুঁজে পেয়েছেন এক সময় এক রকম কথা বলেন, আর এক সময় অন্য রকম। হয়তো যুবকের ছটফটানি, কীভাবে দেশের উন্নতি দ্রুত করা যায় এ সব থেকেই এই নানা রকম কথা। অনুসন্ধান করতে গিয়ে চলতে চলতে কথা বলায় স্ববিরোধের অবকাশ তৈরি হয়। তাঁর অধ্যাত্মজীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা যাঁদের, তাঁরা আবার এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে সন্ন্যাসীকেই বড় করে দেখেছেন। এই সব রকম দেখাই খুবই জরুরি। এই বলাটুকু পড়ে মনে হয়, বিবেকানন্দ তাঁর তাজা মন দিয়ে নানা ভাবে যেন এদেশ-ওদেশের গৃহী মানুষের জীবনযাপনের চেহারাচরিত্র বুঝতে চাইছেন। গৃহধর্ম তাঁর কাছে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ বোঝা যায় তাঁর কর্মযোগ নামের ইংরেজি বক্তৃতা নিবন্ধটি পড়লে। গৃহী-পুরুষের এ যেন হ্যান্ডবুক। গৃহী-পুরুষ সমাজের ভিত্তি। তাঁরা জ্ঞানার্জন করবেন, অর্থ উৎপাদনে উদ্যমী হবেন, আচার-আচরণে ভদ্র হবেন। মেয়েদের কটুকথা বলবেন না। যাকে আমরা বলি নাগরিক ভদ্রলোক, কর্মযোগ যেন তাঁদেরই বিধিগ্রন্থ। পড়তে পড়তে মনে হয় বিবেকানন্দ নিজেও তো অসম্ভব ভদ্রলোক। নানা সমাজে নানা মানুষের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে তাঁকে। ভিনপ্রদেশের দেশীয় রাজারা আছেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষিত নরনারীরাও রয়েছেন। কথায়-বার্তায় আচার-আচরণে এই বাঙালি সন্ন্যাসী অসম্ভব নাগরিক, ভদ্র, তাই তো সহজে সখ্য হয়। দত্ত পরিবারের গ্রুমিং দেখার মতো। এই শিক্ষিত ভদ্র সন্ন্যাসীর পক্ষেই তো কর্মযোগের মতো বই লেখা সাজে, ভোগের উৎকৃষ্ট রূপ কী হতে পারে সেটা বোঝার মতো মন তো এমন সন্ন্যাসীরই থাকতে পারে।
ভাল ভোগ আর খারাপ ভোগ এই দুই চেহারা সংস্কৃত নাটকে দেখানো হয়েছিল। বিবেকানন্দ ভাল ভোগের সূত্রে সংস্কৃত সাহিত্যের উদাহরণ দিয়েছিলেন। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের কথা মনে পড়বে। সেখানে বসন্তোৎসবের দিন বারাঙ্গনা বসন্তসেনা বনের মধ্য দিয়ে ফিরছেন। আঁধার নেমেছে। একা পেয়ে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করলেন। রাজার শ্যালক ও তাঁর সহচর। বসন্তসেনা তাদের বলেছেন, নারী বলের নয়, গুণের অধিকারী। এই নাটকে অভদ্র রাজ-শ্যালকের কথাই ছিল না, ভদ্র বণিক চারুদত্তের কথাও ছিল। চারুদত্তের গুণের অনুরাগী বসন্তসেনা। পুরনো ভারতে মনুর আচারের বাইরে ভোগের যে ভব্য-ভদ্র রূপকল্পনার নানা উপাদান ছিল, বিবেকানন্দ বোধহয় সেটাই তাঁর শিষ্যকে পাশ্চাত্য সভ্যতার সূত্রে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী। ভোগের দর্শন প্রচার তাঁর পরম-উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু দত্ত পরিবারের এই সুশিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান ছেলেটি জানতেন রাজ্যসুদ্ধ সবাই মোটেই সন্ন্যাসী হয়ে যাবে না। তবে গৃহী হলে আদর্শ ভদ্র গৃহী হওয়া চাই। উপার্জনে, উদ্যমে, ভোগে আপত্তি নেই, তবে যেন তা উৎকৃষ্ট হয়। ইদানীং বাসে-ট্রামে, রাস্তায়-ঘাটে অশিষ্ট, মেয়ে পেলেই খাবলাখাবলি করতে চাওয়া যুবা পুরুষদের দেখলে মনে হয়, মৃচ্ছকটিক নাটকের পরজীবী রাজ-শ্যালকের মতো ত্যাগ করতে না শিখুক, সম্মান ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে উৎকৃষ্ট ভাবে ভোগ করতেও যদি শিখত! |
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |