মানুষের স্বাস্থ্য আর রাজ্যের আয়ের মধ্যে কোনটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বৃহস্পতিবার এই প্রশ্ন তুলে দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
গুটখা থেকে রাজ্যের ভাল আয় হয়। তা ছাড়া গুটখার সঙ্গে অনেক মানুষের রুটিরুজি জড়িত। তাই গুটখা মুখের ক্যানসারের অন্যতম কারণ জানা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই নেশার জিনিসটিকে নিষিদ্ধ করবে না। এ দিন হাইকোর্টে এ কথা জানিয়ে দেন রাজ্য সরকারের আইনজীবী। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চের কাছে সরকারের এই যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। অসন্তুষ্ট প্রধান বিচারপতি জানতে চান, “রাজ্যের আয় না ক্যানসার, কোনটি বড় বিষয়?”
সরকারি আইনজীবী জবাব দেন, রাজ্যে ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু গুটখাকে এখনই নিষিদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গুটখার কুফল নিয়ে রাজ্যে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ঠিক কতটা, রাজ্যে মুখের ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা কত, তাঁদের চিকিৎসারই বা কী ব্যবস্থা রয়েছে, কত মানুষ গুটখা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এই সব ব্যাপারে সবিস্তার রিপোর্ট তৈরি করার জন্য হাইকোর্ট রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আইনজীবী নয়নচাঁদ বিয়ানিকে ‘আদালত-বান্ধব’ হিসেবে নিয়োগ করে। বিয়ানির রিপোর্ট পাওয়ার পরেই ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলায় চূড়ান্ত রায় দেবে বলে জানিয়ে দেন প্রধান বিচারপতি।
মুম্বইয়ের একটি সংস্থা এই জনস্বার্থের মামলাটি দায়ের করেছিল। আবেদনকারীর বক্তব্য, গুটখায় মুখের ক্যানসার হয়। তাই সুপ্রিম কোর্ট তার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে সব রাজ্যকেই। ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র-সহ ১৮টি রাজ্য ইতিমধ্যে সেই নির্দেশ রূপায়ণও করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনও তা বাস্তবায়িত করা হয়নি। রাজ্য সরকার যাতে অবিলম্বে গুটখা নিষিদ্ধ করে, তার নির্দেশ দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে এই মামলায়।
মামলার আবেদনকারী সংস্থার অধিকাংশ সদস্যই মুম্বইয়ের একটি ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক। ওই হাসপাতালের মুখের ক্যানসার সংক্রান্ত বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পঙ্কজ চতুর্বেদী বলেন, আইন রয়েছে, প্রচারও হচ্ছে। আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সের কাউকে তামাক জাতীয় জিনিস বিক্রি করা নিষিদ্ধ। তবু পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্যে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে গুটখা, পানমশলা, খৈনি। সহজেই তা পৌঁছে যাচ্ছে অল্পবয়সিদের হাতে। তা থেকে অল্পবয়সিদের মধ্যেও মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। মুম্বইয়ের ওই হাসপাতালের সমীক্ষা বলছে, গুটখার জন্য মুখের ভিতরে, মাড়িতে এবং গলায় ক্যানসার হতে পারে। চতুর্বেদী বলেন, “আমরা ২০ বছরের সমীক্ষায় দেখেছি, মুখের বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এর জন্য গুটখা, পানমশলাই দায়ী। পশ্চিমবঙ্গে মুখের ক্যানসার দ্বিগুণ না-হলেও এ ক্ষেত্রে তারা যে খুব পিছিয়ে নেই, সমীক্ষায় তা ধরা পড়েছে।” সমীক্ষা বলছে, এ রাজ্যে ১২-১৩ বছরের অনেক ছেলেমেয়েও গুটখার নেশা ধরেছে। ১২-১৩ বছর বয়সে ওই নেশা ধরলে ৩০ পেরোনোর আগেই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয় বলে জানান চতুর্বেদী।
গুটখা এবং তামাকজাত অন্যান্য জিনিসের নেশা থেকে রাজ্যে যে-ভাবে মুখের ক্যানসার বাড়ছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের অধিকর্তা অর্ণব গুপ্তও। তিনি বলেন, “মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যাঁরা চিকিৎসার জন্য এখানে আসেন, তাঁদের মধ্যে মাঝবয়সি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ তাঁরা অনেক কম বয়সেই নেশা শুরু করেছেন।” তাঁর মতে, এক বার তামাকের নেশা ধরলে তা ছাড়া বা ছাড়ানো মুশকিল। অনেকে এই নেশা ছেড়ে দেওয়ার পরেও আবার নতুন করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাই ওই সব নেশার সামগ্রীর জোগান বন্ধ হওয়া জরুরি।
ক্যানসারের শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও জানান, পশ্চিমবঙ্গে মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিকার হিসেবে তিনি বলেন, “এখনই রাজ্যে গুটখা ও পানমশলার বিক্রির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা দরকার। কঠোর ভাবে আইন বলবৎ হলে পশ্চিমবঙ্গে এই রোগের প্রকোপ অনেক কমবে।”
সরকার কী বলছে? স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “হাইকোর্ট যা নির্দেশ দেবে, আমরা সেই ভাবেই ব্যবস্থা নেব।” অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে এই নেশার সামগ্রীর বিক্রি আদৌ বন্ধ হবে কি না, সেটা এখন নির্ভর করছে কলকাতা হাইকোর্টের উপরেই। |