নারী নির্যাতনের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু ফরেন্সিক রিপোর্ট যথাসময়ে না হলে কী করে বিচার হবে, সেই প্রশ্ন তুলল রাজ্য মহিলা কমিশন।
গোটা রাজ্যের জন্য রাজ্য সরকারের মাত্র দু’টি ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি। একটি জলপাইগুড়িতে আর অন্যটি কলকাতার বেলগাছিয়ায়। অন্যান্য জেলা থেকে মানুষের রক্ত, লালা, যৌনরস, শুক্রাণু, জামাকাপড়ের নমুনা, সব এসে জড়ো হয় এই দুই জায়গায়। অথচ, সেই দু’টি ল্যাবরেটরি কর্মীর অভাবে ধুঁকছে। পরিকাঠামোর এমনই হাল যে, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হয় পার্ক সার্কাসের কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাব-এ, আর রক্তের ‘অরিজিন’ ও ‘গ্রুপিং’-এর জন্য পাঠিয়ে দিতে হয় কিড স্ট্রিটের সেরোলজিক্যাল ল্যাবে। পরীক্ষার ফলাফল জানতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। পরীক্ষার অপেক্ষায় দু’টি কেন্দ্রেই জমে রয়েছে কয়েক হাজার নমুনা।
ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির এ হেন দুরবস্থার কথা উল্লেখ করেই রাজ্য মহিলা কমিশন প্রশ্ন তুলেছে, প্রত্যেক জেলায় অন্তত একটি ল্যাবরেটরি না-রাখলে ধর্ষণের মতো ঘটনার তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন হবে কী ভাবে? প্রয়োজনীয় নমুনা ফের জমে পড়ে থাকবে বছরের পর বছর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই মর্মে চিঠি পাঠাচ্ছেন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বেশি সংখ্যায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তৈরির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির সংখ্যা ও পরিকাঠামো না-বাড়ালে তদন্তে বা বিচারে কোনও গতি আসবে না।
সুনন্দাদেবীর কথায়, “সিমেন বা স্পার্মের নমুনা যত বেশি দিন পড়ে থাকবে, পরীক্ষায় কোনও প্রমাণ পাওয়ার সম্ভাবনা তত কমে যায়। অথচ আমাদের রাজ্যে দূর দূর জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জলপাইগুড়ি বা কলকাতায় পাঠাতেই সময় চলে যাচ্ছে। সেখানে গিয়েও তা মাসের পর মাস পড়ে থাকছে। আমরা চাই, প্রতি জেলায় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি হোক। সবচেয়ে ভাল হয় জেলা হাসপাতালগুলিতে এটা হলে।”
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “আমরা কিছু ভাবছি না। সেই পরিকাঠামো আমাদের নেই।” এখন প্রশ্ন, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ফরেন্সিক বিভাগ রয়েছে। সেখানেও কি ল্যাবরেটরি তৈরি করা যায় না? স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি, “মেডিক্যালের আর ল্যাবরেটরির ফরেন্সিক কাজের মধ্যে কোনও মিল নেই। ফরেন্সিক ল্যাবে কোনও ডাক্তার লাগে না। ওদের কাজের পদ্ধতি আলাদা। তাই মেডিক্যাল কলেজে ফরেন্সিক ল্যাবেরটরি তৈরির বিষয়টি অবাস্তব।”
ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির অভাবে এবং পরিকাঠামোর দুরবস্থায় ধর্ষণ-সহ বিভিন্ন মামলার নিষ্পত্তিতে দেরির কথা স্বীকার করেছেন রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তা এবং ল্যাবরেটরির পরীক্ষকেরা। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্তার কথায়, “মালদহ, দুর্গাপুরে ল্যাবরেটরির জন্য কথা চলছে। কবে তা বাস্তবায়িত হবে কেউ জানে না।” বেলগাছিয়ায় ল্যাবরেটরি এবং জলপাইগুড়িতে স্টেট রিজিওন্যাল ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষের স্বীকারোক্তি, লোক না বাড়ালে দ্রুত নমুনা পরীক্ষা অসম্ভব।
বেলগাছিয়ার একাধিক কর্তা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে বছরে ৯০০-১২০০ বিভিন্ন রকমের নমুনা আসে। তার মধ্যে ৬০ শতাংশই ধর্ষণের অভিযোগের নমুনা। অথচ, ধর্ষণের নমুনাগুলি পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবেন এমন অফিসার এখানে রয়েছেন মাত্র এক জন। তাঁর এক সহযোগী ও এক জন মাত্র চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছেন। ওই একমাত্র অফিসারকে অধিকাংশ দিন কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবেন কী করে? সেখানকার কর্তৃপক্ষই জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে ল্যাবরেটরিতে প্রায় চার হাজার নমুনা পরীক্ষার অভাবে জমে আছে যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি-ই ধর্ষণের মামলার নমুনা।
একই বক্তব্য জলপাইগুড়ির ল্যাবরেটরির। সেখানেও ধর্ষণের নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়ার এক জন অফিসার রয়েছেন। বছরে সেখানে প্রায় ৬০০ নমুনা আসে যার ৭০ শতাংশ ধর্ষণের মামলার। তাঁদের ল্যাবরেটরিতেও প্রায় তিন হাজার নমুনা জমা রয়েছে। জলপাইগুড়ির এক অফিসারের কথায়, “রক্তের অরিজিন বা গ্রুপিংয়ের জন্য আমাদের নমুনা কলকাতার সেরোলজিক্যাল ল্যাবে পাঠাতে হয়। ধর্ষণের ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষা খুব জরুরি। কিন্তু দু’টি স্টেট ল্যাবরেটরির কোনওটিতে এই পরীক্ষা হয় না। নমুনা পাঠাতে হয় পার্ক সার্কাসের কেন্দ্রীয় ল্যাবে। এই নমুনা আনা-নেওয়া সময়সাপেক্ষ। কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতেও প্রচুর নমুনা এসে জমা হয়।”
এই ম্যারাথন প্রক্রিয়া যতদিন চলবে, ততদিন ধর্ষণ-সহ বিভিন্ন অপরাধের তদন্তের দ্রুত নিষ্পত্তি এক কথায় সোনার পাথরবাটি। |