নিয়মের তোয়াক্কা না-করে মানবশরীরে ওষুধের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষার অভিযোগ উঠেছে এ রাজ্যের একাধিক সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এই ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্যই সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে।
কেন্দ্রের সমালোচনা শুনে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য-কর্তারাও নড়েচড়ে বসেছেন। এবং পরিস্থিতি বিচার করে তাঁদের উপলব্ধি, ও দিকে নজরদারির বিশেষ ব্যবস্থা এখানে নেই। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, “সরকারি হাসপাতালের যে এথিক্যাল কমিটি, ট্রায়াল শুরুর আগে তাদেরই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার কথা। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তাই কিছু বলা সম্ভব নয়।”
তবে ওষুধ নিয়ে কাজ করা বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অভিযোগ: বেসরকারি তো বটেই, সরকারি হাসপাতালেও অনেক ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নিয়ম মানা হচ্ছে না। যেমন, স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে হালে অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এথিক্যাল কমিটির অনুমোদন না-নিয়ে রোগীদের উপরে ওষুধের ট্রায়াল চালানোর। স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, অভিযোগগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে আরও সক্রিয় হতেই হবে।” বলছেন সুশান্তবাবু।
উল্লেখ্য, বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার যথেচ্ছ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে লাগাম দিতে ব্যর্থতার জন্যই মূলত কেন্দ্রের সমালোচনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এ ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ভূমিকাও জানতে চেয়েছে তারা। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, মানুষকে গিনিপিগ বানানোর এই প্রক্রিয়ায় দাঁড়ি টানতে সরকারকেই কড়া হতে হবে। তাই রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বিভিন্ন হাসপাতাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে নির্দেশিকা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা কী রকম?
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজি-র শিক্ষক স্বপন জানা জানাচ্ছেন, রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কী ভাবে হয়, কয়েক বছর আগে তা নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেখা যায়, একাধিক কলেজে আইন ও নীতি মেনে কমিটি গড়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে এথিক্যাল কমিটিতে ফার্মাকোলজি’র চিকিৎসক থাকেন না। এমনকী, কোথাও কোথাও ট্রায়ালের রেকর্ড রাখার ঘরই নেই! “উপরন্তু গত বছর সংসদের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে ডাক্তারদের একাংশের সঙ্গে ওষুধ সংস্থার আঁতাতের ছবিটা সামনে এসেছে। এ রাজ্যেও বহু ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানি নিয়ম না-মেনে সরাসরি ডাক্তারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কিছু জানানো হয়নি। ফলে সমস্যা হলে কর্তৃপক্ষেরও কোনও দায় নেই।” আক্ষেপ স্বপনবাবুর। আরজি করের রেডিওথেরাপি’র প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে স্বচ্ছতা কম। উপযুক্ত নজরদারি না-থাকলে বহু মানুষের ক্ষতি।”
বস্তুত নজরদারিতে ঘাটতির সুযোগ নিয়ে একাধিক বেসরকারি হাসপাতালও যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। যে প্রসঙ্গে এক বেসরকারি হাসপাতালের সিওও তথা ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’-র সদস্য রূপক বড়ুয়া বলছেন, “সরকারের উচিত, লাইসেন্স নবীকরণের সময়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সংক্রান্ত কাগজপত্র চাওয়া। কোথাও তো একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থাকা উচিত! এখন স্রেফ সদিচ্ছাই ভরসা।”
তবে ভিন্ন মতও আছে। একটি মহলের দাবি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পর্যাপ্ত নজরদারি রয়েছে। যেমন এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি-র শিক্ষক-চিকিৎসক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মানুষকে গিনিপিগ বানানো হয়, এ কথাটার কোনও অর্থ নেই। তা হলে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষাই বন্ধ করে দিতে হয়। আমরা যে ওষুধ খাই, তার সবই তো কারও না কারও উপরে পরীক্ষার পরে বাজারে এসেছে!” তাঁর দাবি, সরকারি হাসপাতালে এথিক্যাল কমিটি যথেষ্ট কঠোর। বহু সময়ে ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেলের অনুমোদন সত্ত্বেও কমিটি প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। এ দেশে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রিও চালু করেছে। যাবতীয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সেখানে নথিভুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক বলে জানান তিনি। কিন্তু অনুমোদন পর্ব তো কাজ শুরুর আগে! এথিক্যাল কমিটি হোক, বা আইসিএমআর কেউই ট্রায়াল চলাকালীন নজরদারি চালায় না। সে দায়িত্ব কার? স্বাস্থ্য-কর্তারা নিরুত্তর। আশঙ্কা অগত্যা থেকেই যাচ্ছে। |