|
|
|
|
মোবাইলে পুলিশের বেড়ি, রাগের চোটে আছড়ে ফেললেন কলম |
দাপুটে নেতাকে ধাওয়া করে সাঁড়াশি ফাঁদে |
শুভাশিস ঘটক • কলকাতা |
পরনে আকাশি নীল ফুলশার্ট, গাঢ় নীল জিন্স। পায়ে দামি স্নিকার্স। থমথমে মুখে বারুইপুর কোর্টের লক-আপে বসে রয়েছেন তিনি। মোবাইলে কাউকে ফোন করবেন, তারও উপায় নেই!
তিনি, অর্থাৎ ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম। যাঁকে ক’দিন আগে ‘উদ্যমী’ ও ‘তাজা নেতা’ হিসেবে অভিহিত করেছিল তাঁর দল। গত ৬ ও ৮ ফেব্রুয়ারি ভাঙড়ের জোড়া হাঙ্গামার পরে যাঁর পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৃণমূলের তাবড় নেতারা। তা সত্ত্বেও এমনটা কী করে হল, ভেবে থই পাচ্ছেন না প্রাক্তন ওই বিধায়কের ঘনিষ্ঠেরা।
|
বারুইপুর আদালতে।
—নিজস্ব চিত্র |
বস্তুত এমনটা যে হতে পারে, আরাবুল নিজেও তা আঁচ করতে পারেননি। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও ছিলেন দিব্যি খোশমেজাজে। জামিন-অযোগ্য ধারার মামলা মাথায় নিয়ে বুধবার হাসিমুখে হাজির হয়েছিলেন ভাঙড় কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে, কলেজের পরিচালন কমিটির সভাপতি হিসেবেই। জেলা পুলিশের একাধিক কর্তাকে এ ক’দিন নিয়মিত ফোনও করে গিয়েছেন। কিন্তু টের পাননি, তলে তলে পট পাল্টানোর তোড়জোড় চলছে। যখন টের পেলেন, ততক্ষণে সব পথ বন্ধ।
কী ভাবে ধরা পড়লেন আরাবুল?
জেলা পুলিশ-সূত্রের খবর: দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের কর্তারা বুধবার রাতে গঙ্গাসাগর মেলার ডিউটি শেষ করে ফেরার পরেই গ্রেফতারের ছক কষা শুরু হয়। পুলিশ-কর্তারা কথা বলেন স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে। পুলিশের যে অফিসারদের আরাবুল ফোন করেছিলেন, তাঁদের দিয়ে ওঁকে ডেকে পাঠানোর চেষ্টা হয়। পুলিশের সন্দেহ, এতেই আরাবুল বুঝতে পারেন, একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তাই গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যে কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাঁর দু’টি মোবাইলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে জানায় পুলিশ। এমনকী, তাঁর গাড়ির চালকের মোবাইলও সুইচ অফ ছিল।
তবে পুলিশ-কর্তাদের দাবি: আরাবুল যে এলাকা ছেড়ে পালাতে পারেন, সেই সম্ভাবনা তাঁরাও মাথায় রেখেছিলেন। তাই তৃণমূল নেতার পিছনে চর লাগানো হয়েছিল। বেলার দিকে চরের মুখে খবর আসে, আরাবুল লাল রঙের টাটা সুমোয় চড়ে বেরোচ্ছেন। আশপাশের সব থানাকে সেই গাড়ির নম্বর জানিয়ে সতর্ক-বার্তা পাঠানো হয়। তার পরে পুলিশ জাল বিছায়। ভাঙড়ের দাপুটে নেতাকে পাকড়াও করতে মাঠে নামেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের বাছাই করা অফিসারেরা। নেতৃত্বে, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পশ্চিম) কঙ্করপ্রসাদ বারুই।
শিকারের দেখা মিলল যখন, ঘড়িতে তখন বেলা পৌনে একটা। ঘটনাস্থল, প্রগতি ময়দান থানা-এলাকা।
বাসন্তী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ওত পেতে থাকা অফিসারেরা দেখলেন, আরাবুলের গাড়ি আসছে। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কেত দেওয়া হল আগে মোতায়েন অফিসারদের। আর আরাবুলের গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পরে পুলিশের কয়েকটা এসইউভি তার পিছু নিল। সামনে সামনেও চলল পুলিশের গাড়ি। পিছন থেকে বেশ কিছুটা রাস্তা ধাওয়া করে আরাবুলকে ‘সাঁড়াশি ফাঁদে’ ফেলা হয় সামনে-পিছনে পুলিশের গাড়ি, মাঝে সেই লাল সুমো।
আরাবুলের চালক বাধ্য হয়ে গাড়ি থামান। পুলিশ অফিসারেরা গিয়ে প্রাক্তন বিধায়ককে নামিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলেন। আরাবুল তখন হতভম্ব। “উনি ভাবতেই পারেননি, এমনটা হতে পারে! গাড়িতে বসে পুলিশকে হুমকি দিতে থাকেন। নাগাড়ে ফোন করতে থাকেন দলের লোকজনকে।’’ জানাচ্ছেন এক অফিসার।
শেষ পর্যন্ত তাঁর দু’টো মোবাইলই কেড়ে নেন পুলিশ অফিসারেরা। ফোনগুলোকে অফ করে রাখা হয়। আরাবুলকে নিয়ে পুলিশের ইনোভা রওনা দেয় বারুইপুরের দিকে। সেখানকার মহকুমা আদালতে তাঁকে পেশ করার জন্য।
তবে কোর্টে পৌঁছানোর আগে আর এক প্রস্থ নাটক হয়ে যায় বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে, যেখানে আরাবুলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শারীরিক পরীক্ষা করাতে। বেলা তখন প্রায় দেড়টা। প্রত্যক্ষদর্শী-সূত্রের খবর: রাগে প্রায় ফুঁসতে-ফুঁসতে আরাবুল হাসপাতালে ঢোকেন। ডাক্তারের ঘরে বসে থাকার সময়ে পুলিশ অফিসারেরা তাঁকে মোবাইল দু’টি ফিরিয়ে দেন। তবে এ-ও বলে দেন, ভুলেও যেন ফোন অন করা না-হয়। তা হলে আবার নিয়ে নেওয়া হবে।
‘ফতোয়া’ শুনে আরাবুল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেও চেঁচামেচি করেননি। দাঁতে দাঁত চেপে ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন। এক বারই রেগে যান, যখন তাঁকে ডাক্তারি পরীক্ষার খাতায় সই করতে বলা হয়। সই করে কলমটিকে টেবিলের উপরে রীতিমতো আছড়ে ফেলেন তিনি। হাসপাতালের কাজ সেরে ওঁকে তোলা হয় একটা সুমোয়। তাতে চড়েই রাগি মুখে বারুইপুর আদালত চত্বরে এসে নামেন পুলিশ পরিবেষ্টিত আরাবুল ইসলাম।
আদালতের নির্দেশে আপাতত আরাবুলকে পুলিশ-হেফাজতে থাকতে হবে। ধৃত নেতাকে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার পরিবর্তে সোনারপুর থানার হাজতে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। বিচারকের রায় শুনে ভেঙে পড়েন আরাবুলের স্ত্রী জাহানারা বিবি। আদালত চত্বরে দেখা যায়, ছেলে হাকিবুলের কাঁধে মাথা রেখে তিনি হাউহাউ করে কাঁদছেন।
তবে আরাবুলের গ্রেফতারির খবরে তাঁর নিজের তল্লাটে বিশেষ তাপ-উত্তাপ এ দিন চোখে পড়েনি। মাস কয়েক আগে যে দিন ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকা নিগ্রহ মামলায় তাঁকে এই বারুইপুর কোর্টেই হাজির হতে হয়েছিল, সে দিন কিন্তু আদালত চত্বর ভরে গিয়েছিল তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের থিকথিকে ভিড়ে। এ দিন তাঁদের দেখাও মেলেনি। “নেতারাই যখন ওঁর সঙ্গ ছেড়েছেন, আমরা আর থাকব কেন?” মন্তব্য ভাঙড়ের এক তৃণমূল-সমর্থকের।
ওঁরাও বুঝেছেন, কোথাও যেন তাল কেটে গিয়েছে!
|
অভিযুক্ত আরাবুল |
ভারতীয় দণ্ডবিধি |
কী অপরাধ |
কেমন ধারা |
৩০৭ |
খুনের চেষ্টা |
জামিন-অযোগ্য |
৩২৬ |
অস্ত্র দিয়ে কাউকে আঘাত করা |
জামিন-অযোগ্য |
*২৫/২৭ |
বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার |
জামিন-অযোগ্য |
**৯(বি) |
বোমা ছোড়া |
জামিন-অযোগ্য |
১৪৯ |
অপরাধের উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া |
জামিনযোগ্য/জামিন-অযোগ্য |
৫০৬ |
খুনের হুমকি |
জামিনযোগ্য |
৩২৫ |
কাউকে মারাত্মক আঘাত করা |
জামিনযোগ্য |
৩২৩ |
মারধর |
জামিনযোগ্য |
১৪৭ |
দাঙ্গা-হাঙ্গামা |
জামিনযোগ্য |
১৪৮ |
অস্ত্র নিয়ে হাঙ্গামা |
জামিনযোগ্য |
৪২৭ |
গোলমাল ও ভাঙচুর |
জামিনযোগ্য |
*অস্ত্র আইন ** বিস্ফোরক আইন |
|
|
|
|
|
|