|
|
|
|
১১ দিন পরে অবশেষে পাকড়াও আরাবুল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
চাকা ঘুরতে লাগল ১১ দিন।
ভাঙড়ে সিপিএম নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলার ঘটনার পরে দলীয় নেতৃত্বের ঢালাও প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১১ দিনে প্রশাসনের অবস্থান বদলে গেল ১৮০ ডিগ্রি। রীতিমতো ছক কষে পিছু ধাওয়া করে পুলিশ পাকড়াও করল ভাঙড় অঞ্চলে অবিসংবাদী তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামকে। তাঁর বিরুদ্ধে শুধু রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলাই নয়, দু’দিন বাদে বামনঘাটায় সিপিএম সমর্থকদের উপরে আক্রমণ-সহ মোট পাঁচটি জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযোগ আনা হল। যার ফল, পাঁচ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজত হল আরাবুলের।
বারুইপুর মহকুমা আদালতের বিচারক হিমিকা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে আরাবুলকে পেশ করে নিজেদের হেফাজতে রাখার আবেদন করে পুলিশ। বিচারক সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। আদালত থেকে সোনারপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরাবুলকে। এই আরাবুলই কয়েক দিন আগে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরে দাবি করেছিলেন, তিনি যা করেছেন, তাতে দল ও সরকার তাঁর পক্ষেই আছে।
ঘটনাচক্রে যে দিন আরাবুলকে গ্রেফতার করা হল বাইপাসের কাছ থেকে, সে দিনই রেজ্জাককে দেখতে এলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, সিপিএমের রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে ভাবে দলের প্রবীণ বিধায়ক রেজ্জাকের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যে ভাবে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা তৃণমূল-বিরোধী প্রচার শুরু করেছেন, তাতে কিছুটা হলেও আশঙ্কার মেঘ দেখছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বিশেষ করে সামনে পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে
রেজ্জাকের মতো এক জন প্রবীণ সংখ্যালঘু নেতার উপরে হামলার ঘটনা মানুষ যে ভাল ভাবে নেয়নি, সেটা বিভিন্ন মহলের ক্ষোভ থেকেই স্পষ্ট। আরাবুলও সংখ্যালঘু। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রবীণ রেজ্জাকই সহানুভূতি পেয়েছেন। এর ছাপ পঞ্চায়েত ভোটে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
গ্রেফতারের পরে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “আরাবুলকে গ্রেফতার করিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজধর্ম পালন করেছেন।” তৃণমূল নেতারা বলছেন, তাঁদের আমলে প্রশাসন রং বিচার করে চলে না এই ঘটনাই তার প্রমাণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠছে, রাজধর্ম পালন করতে এত দিন সময় লাগল কেন? ঘটনার পরপরই মহাকরণ এবং ভাঙড়ে
দাঁড়িয়ে শাসক দলের একাধিক নেতা এবং মন্ত্রী কিন্তু আরাবুলেরই পক্ষ নিয়েছিলেন। তা হলে হঠাৎ এমন বোধোদয় কেন?
এর পিছনে প্রবীণ রেজ্জাকের উপরে হামলার ঘটনা মানুষের ভাল ভাবে না নেওয়া তো বটেই, সঙ্গে আরও একাধিক কারণ দেখছেন রাজনীতির কারবারিরা। একে তো সিপিএম রেজ্জাক-কাণ্ডকে সর্বভারতীয় স্তরে প্রচারে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তার আগে আরাবুলের মাথার উপর থেকে হাল তুলে নিয়ে কারাটদের পালের হাওয়া কেড়ে নিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ প্রশাসন ও শাসক দলের অপদার্থতার বিরুদ্ধে টানা সওয়াল করে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই রাজ্যপাল প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, “যা চলছে তা এক ধরনের গুন্ডারাজ।” |
|
গ্রেফতারের আগে ডাক্তারি পরীক্ষা। বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে আরাবুল। —নিজস্ব চিত্র |
মহাকরণ সূত্রের খবর, রেজ্জাকের উপরে হামলার দিনের ভিডিও
ফুটেজে আরাবুলের ছবি থাকায় প্রশাসনের উপরে চাপ আরও বেড়েছিল। রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তার কথায়, “বিষয়টি সংবেদনশীল। তাই কিছুটা সময় লেগেছে। তবে ভিডিও ফুটেজ থাকায় আরাবুলকে গ্রেফতার করতে প্রশাসনের সুবিধা হয়েছে।” তাঁর মন্তব্য, “এর পরেও গ্রেফতার করা না হলে প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় বলে মনে হত।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, আরাবুলকে নিয়ে সমস্যা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ভাঙড়ের তরুণ নেতাকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। কয়েক দিন আগে তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে ডেকে আরাবুলকে বোঝানোরও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব এর পরে অন্য রকম ভাবতে শুরু করেন। যদিও প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মতো বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ বলছেন, “রাজ্যপাল-সহ বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে পড়েই তৃণমূলের সরকার আরাবুলকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে!” তবে বাস্তব হল, তত দিনে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের একাংশও মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে আইনকে আইনের পথে চলতে দেওয়াই ভাল। ভাঙড় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মুখ্যমন্ত্রী তথা
পুলিশমন্ত্রী মমতার গোচরে আনা হয়। এর পরেই পট পরিবর্তন হয়। সরকারেরই একটি সূত্রের আরও বক্তব্য, গঙ্গাসাগর মেলা এবং ‘বেঙ্গল লিডসে’র মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাঝে আরাবুলকে গ্রেফতারের ঝুঁকি নিতে চায়নি প্রশাসন। মেলা শেষ হয়েছে বুধবার। আর ‘বেঙ্গল লিডস’ শেষ হল বৃহস্পতিবারে। সেই দিনই তৎপর হল প্রশাসন।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ভাঙড় নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “আজও বলছি, আরাবুল উদ্যমী ছেলে! কিন্তু তার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ ওঠে, তবে আইন আইনের পথেই চলবে।” আহত রেজ্জাকের কিন্তু সন্দেহ, গোটা ব্যাপারটাই পরিকল্পনা মাফিক ঘটছে। তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশ করেই হামলা এবং আরাবুলকে এখন গ্রেফতার করা হল। সিপিএমের আশঙ্কা, আরাবুলকে গ্রেফতারের পরে এ বার নিরপেক্ষতা দেখাতে ভাঙড়ে রেজ্জাকের ডান হাত সাত্তার মোল্লা তো বটেই, এমনকী রেজ্জাকের দিকেও হাত বাড়াতে পারে সরকার। কারণ, কাঁটাতলায় হামলার পরে রেজ্জাকের বিরুদ্ধেও প্ররোচনা দেওয়া এবং উত্তেজনা ছড়ানোর পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছিলেন আরাবুল।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে রেজ্জাক, সাত্তারদের গ্রেফতার করা গেলে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সিপিএমকে যে বেকায়দায় ফেলা যাবে, তা জানে তৃণমূল। তবে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য এড়ান মুকুল রায়, পার্থবাবুরা। তাঁদের বক্তব্য, “এটা পুলিশের দায়িত্বে পড়ে। আশা করব, পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করবে।” তবে সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়ার অভিযোগ, “সাত্তারকে খুনের মামলায় নিম্ন আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু বাম সরকার হাইকোর্ট থেকে সাত্তারের জামিন করিয়ে নেয়।”
এ সব মাথায় রেখেই সিপিএম নেতৃত্ব ভাঙড় নিয়ে সরকারের উপর থেকে চাপ কমাতে নারাজ। রেজ্জাকের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে কারাট বলেছেন, “এটা (আরাবুলকে গ্রেফতার) প্রথম পদক্ষেপ। হামলায় দায়ী সকলকে ধরা উচিত ও আইনকে নিজের পথে চলতে দেওয়া উচিত।” কলকাতায় এ দিনই শুরু দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পেশ করা রিপোর্টেও কারাট বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র যে ভাবে আক্রান্ত, তার বিরুদ্ধে গোটা দেশেই তাঁরা সরব হবেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে রিপোর্ট দিয়ে বিমান বসু বলেন, শুধু প্রবীণ বিধায়কই নন, সমাজের নানা অংশই এখন আক্রমণের মুখে। তাই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে দলের কর্মী-সমর্থকেরা বেশি করে বেরোচ্ছেন, মানুষের সাড়াও মিলছে।
|
প্রতিবাদে বোমাবাজি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আরাবুলকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজার ও কাঁঠালিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বোমাবাজি, দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, নেতৃত্বে ছিলেন ভোগালি-২ পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান মোদারসের হোসেন।
|
|
আরাবুলনামা |
কেন চাপে সরকার
• রাজ্য জুড়ে সিপিএমের
আন্দোলন,
পাশে কারাটরাও।
• গুন্ডারাজ চলছে বলে রাজ্যপালের মন্তব্য।
• সরকারকে সতর্ক হতে বলে শঙ্খ
ঘোষের মতো বিশিষ্টজনের বিবৃতি।
• প্রবীণ সংখ্যালঘু বিধায়কের
উপরে হামলায় ক্ষুব্ধ মানুষ।
• পঞ্চায়েত ভোটে এই ঘটনার
আঁচ পড়ার আশঙ্কা।
• তৃণমূলের নেতাদের
মধ্যেও ক্ষোভ।
• শহরের মানুষের ক্ষোভ এবং
সংবাদমাধ্যমের একাংশের চাপ। |
ভাঙড় নিয়ে আরাবুল
রেজ্জাক সাহেব নিজের
জামা ছিঁড়ে
গাড়ির কাচ ভেঙে নাটক করছেন।
রেজ্জাকের অবস্থা
কোমরের কাছে শিরদাঁড়ার এক ও তিন
নম্বর হাড়ে চিড়। হাসপাতালে ভর্তি। |
|
|
গ্রেফতারের আগে |
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় |
গ্রেফতারের পরে |
আরাবুল উদ্যমী ছেলে।
রেজ্জাকের
সঙ্গে লড়তে
গেলে
কি যুধিষ্ঠির দিয়ে হবে! |
এখনও বলছি আরাবুল
উদ্যমী ছেলে।
তবে আইন
আইনের
পথে চলবে। |
|
আরাবুল আমাদের
তাজা নেতা।
গোটা দল
তার পাশে আছে। |
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র |
লড়াকু নেতা গ্রেফতার
হবে না,
এমন কোনও
কথা নেই।
আমরাও
তো গ্রেফতার হয়েছি। |
|
|
|
|
|
|