দু’লক্ষ টাকা করে ১,৬০০ ক্লাবকে সাহায্য দেওয়ার সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে ঘিরে অনিয়ম, স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। এলাকার সাংসদ বা বিধায়কের সুপারিশকে এই টাকা পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত করে রাজ্য সরকার বৈষম্য এবং আর্থিক অস্বচ্ছতাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর। খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িত ক্লাবগুলো সুপারিশের অভাবে কেন বঞ্চিত হবে, অনুদানের টাকা খরচ করার নির্দিষ্ট ‘গাইডলাইন’ দেওয়া হল না কেন উঠেছে প্রশ্ন। এমনকী, প্রাপক নির্বাচন নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগও মিলছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলেরই অন্দর থেকে।
রাজ্যের একাধিক ক্লাবের কর্মকর্তা, ক্রীড়াবিদদের বক্তব্য, সরকারি সাহায্য বিলির সিদ্ধান্ত হলে, সে জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আবেদনপত্র চাওয়াটাই প্রথা। প্রশাসন সূত্রের খবর, এ বার ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার আগে তাদের রেজিস্ট্রেশনের শংসাপত্র, তিন বছরের অডিট রিপোর্ট, ক্লাবের সাধারণ সভার বিবরণী এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রমাণপত্র-সহ বেশ কিছু নথি পরীক্ষা করার কথা রাজ্যের। অনুদান দেওয়ার আগে রাজ্যের সমস্ত বিধায়ককে তাঁদের এলাকার দশটি করে ক্লাবের নাম সুপারিশ করে তালিকার আকারে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রাজ্য স্তরে এই তালিকার ‘কো-অর্ডিনেশনে’র দায়িত্বে ছিলেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বঞ্চিত’দের অন্যতম ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘লালগড় সজীব সঙ্ঘ’। ষাট বছরের পুরনো এই ক্লাবের নিজস্ব মাঠ রয়েছে। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে সেই মাঠেই সরকারি উদ্যোগে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের উপস্থিতিতে জঙ্গলমহল ফুটবল কাপের প্রথম খেলাটি হয়েছিল। ক্লাব সম্পাদক তপনকুমার তিওয়ারির ক্ষোভ, “আমাদের মাঠে একাধিক বার সরকারি উদ্যোগে ফুটবল খেলা হল। অথচ, সরকারি সাহায্য পেলাম না।” মুর্শিদাবাদের ডোমকল এলাকার ইসলামপুরের ‘বাইশ ভাই’ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭০-এ। সম্পাদক বিবেকানন্দ রায় বলেন, “সরকারি অনুদান মেলেনি।” একই সুর শান্তিপুর জে এ আই ক্লাব-এর সম্পাদক আনসার আলির। তাঁর ক্ষোভ, “আমরা ফুটবলে পাঁচ বারের জেলা চ্যাম্পিয়ন। তিন বার রাজ্য লিগের সেমিফাইনালে পৌঁছেছি। প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন ফুটবলারের প্রশিক্ষণ শিবির চালাই। আমরা কেন বাছাই-তালিকায় নেই?” উষ্মার ছোঁয়া হুগলির চাঁপাদানির বিএস পার্ক ক্লাবের কর্মকর্তা সৌমেন ঘোষের গলাতেও। বর্ধমান শহরের নামকরা ক্লাব কল্যাণ স্মৃতি সঙ্ঘ বা ৭৫ বছরের ‘আরএইউসি’ আবেদন করেও অনুদান পায়নি। তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক ক্লাব অনুদান পেয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। কোচবিহারের চালতাতলা যুবসঙ্ঘের সহ-সভাপতি সুব্রত দত্তর বক্তব্য, “ফি বছর ক্রিকেট, ফুটবল, সাঁতারের মতো খেলায় আমরা বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত দল পাঠাচ্ছি। কী ভাবে অনুদান পেতে হয়, সেটাই কেউ জানাননি।”
ক্লাব-কর্তাদের অভিযোগ যে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, মানছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার পদাধিকারিকেরাও। বীরভূম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অনেক ক্লাব অনুদান পেল যাদের সঙ্গে খেলাধুলার সর্ম্পক নেই। অথচ যারা বছরভর খেলাধুলা-প্রশিক্ষণ শিবির করে, তারা সরকারি সাহায্য পায়নি।” বীরভূমের রামপুরহাট শহরের ‘নবীন ক্লাব’ রয়েছে অনুদান-প্রাপকদের তালিকায়। ক্লাবের সদস্য তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি সুকান্ত সরকার। অনুদানের টাকায় কী করবেন? ক্লাবের সম্পাদক উজ্জ্বল ধীবরের জবাব, “ক্লাবঘরের ছাদ ঢালাই করব।”
ক্লাব বাছাইয়ের এই সূত্রেই এসেছে রাজনৈতিক ‘আমরা-ওরা’র অভিযোগ। বহরমপুরের ‘গোরাবাজার নবারুণ সমিতি’র সম্পাদক তথা বহরমপুর টাউন কংগ্রেস সভাপতি অতীশ সিংহ, সাঁইথিয়ার সিপিএম বিধায়ক ধীরেন বাগদিদের অভিযোগ, অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রংই প্রাধান্য পেয়েছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কোপেও ক্লাবের নাম বাদ পড়েছে বলে দাবি বীরভূমের এক তৃণমূল বিধায়কের। তাঁর কথায়, “আমি জেলাস্তরে দলের এক শীর্ষ নেতার বিরোধী গোষ্ঠীতে আছি। আমার সুপারিশ করা পাঁচটি ক্লাব বাদ পড়েছে।” সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ব্লক থেকে মহকুমা থেকে জেলা স্তর হয়ে তালিকা মহাকরণে পৌঁছেছে। সব শর্ত পূরণ না করায় বা দেরি করায় কোনও ক্লাবের নাম বাদ পড়েছে। এখানে আমরা-ওরা করা হয়নি।” তবে কংগ্রেস নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির কটাক্ষ, “আগেও সরকার বিভিন্ন ক্লাবকে টাকা দিয়েছিল। এটা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছে।” |