আগে এমনটা প্রায় হত না বললেই চলে।
বয়স ছাপ্পান্ন, রোগাপাতলা চেহারা, শ্বাসকষ্টের রোগী, কলেজ স্ট্রিটে পৈতৃক বাড়ি— ভদ্রলোকের নাম সমীরকুমার রায়। উত্তম বাগচির পারিবারিক পাইলিংয়ের ব্যবসা আছে। কসবা রথতলায় বাড়ি, বয়স চল্লিশ। নিউ বালিগঞ্জ সেকেন্ড লেনের বছর আঠাশের শতদ্রু রায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আর পাঁচ জন আম বাঙালির সঙ্গে এঁদের সে অর্থে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু চিরাচরিত গা-বাঁচানো মানসিকতার খোলস থেকে বেরিয়ে তিন জন এক সঙ্গে ‘অন্য রকম’ একটা কাজ করে ফেলেছেন বুধবার সন্ধ্যায়।
পুলিশ সূত্রের খবর, ভর সন্ধ্যায় বিবাদী বাগের ব্যস্ত রাস্তায় প্রকাশ্যে অপরিচিতা এক তরুণীর শ্লীলতাহানি করার অভিযোগে ছ’জন যুবককে ওই তিন পথচারীই কিল-চড়-ঘুঁষি মেরে কাবু করে প্রায় ৫০০ মিটার টানতে-টানতে লালবাজারে এনে পুলিশ অফিসারদের হাতে জমা দিয়েছেন। যে-তরুণীকে নিয়ে এত কিছু তিনি অবশ্য প্রকাশ্যে আসতে চাননি, অভিযোগ করার সাহস পাননি এবং ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছেন। তাতেও দমেননি ওই তিন জন।
তা হলে কারও বিপদ দেখে দরজায় শিকল তোলার প্রবণতা ভেঙে বেরিয়ে আসা শুরু হয়েছে বাঙালির? দিল্লির বাসে গণধর্ষণ এবং এই রাজ্যের কিছু ঘটনাই কি সেই বিবেক জাগানোর কাজ করছে?
সমীরবাবুর কথায়, “আমার নিজের মেয়ে ঠিক ওই মেয়েটির বয়সী। ছেলেগুলো রাস্তা পার হওয়ার সময় অশ্লীল কথা বলে অভব্যতা করে ওকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মারল। আমার মাথাটা কেমন যেন ঝাঁ করে জ্বলে উঠল। তত ক্ষণে আরও দু’টি ছেলে ওই ছেলেগুলোকে মারতে শুরু করেছে।” আর শতদ্রু ও উত্তমের বক্তব্য, “শুধু মোমবাতি জ্বেলে মিছিল করে কী হবে? এক জন অপরাধ করছে দেখে চার জনে মিলে প্রতিবাদ না করলে আমাদের ভবিষ্যৎই অন্ধকার।” |
অভিজিৎ মিত্র কিংবা সুস্মিতা ভট্টাচার্যের মতো সমাজতত্ত্ববিদদের কথায়, “আগের চেয়ে সংখ্যায় বেশি করে মেয়েদের এগিয়ে এসে অভিযোগ দায়ের করা, লাগাতার সংবাদমাধ্যমের প্রচার বা নিজের পরিচিত কারও এমন কোনও দিন হতে পারে, এই রকম একটা ধারণা মনে ঢুকে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে।” আবার পরিবর্তন হচ্ছেও না।
কারণ, কয়েক জন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও সেই তরুণী নিজে কিন্তু অভিযোগ জানাতে এগিয়ে আসেননি। আর সেই যুক্তি দেখিয়ে প্রথমটায় অভিযুক্তদের হাতে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
সুস্মিতা দেবীর বক্তব্য, “ওই তরুণী হয়তো ভেবেছেন, তাঁকে নিয়মিত ওই জায়গা দিয়েই যাতায়াত করতে হয় এবং সব সময়ে তিনি ওই রকম শুভাকাঙ্ক্ষী পাবেন না। কিন্তু তাঁর অসম্মান রুখতে সম্পূর্ণ অপরিচিতেরা এগিয়ে গিয়েছেন, এটা ভাল লক্ষণ।” সমাজবিদদের মতে, পুলিশ-প্রশাসনের অবশ্যই উচিত এই মানবিক পরিবতর্নকে সাহায্য করা, না-হলে অপরাধেরই জয় হবে।
আর ডালহৌসির ঘটনায় পুলিশ সেই সাহায্যটাই করেনি বলে অভিযোগ শতদ্রুদের। তাঁদের বক্তব্য, “পুলিশ সে ভাবে আমাদের কোনও সহযোগিতা করেনি। ওঁরা উল্টে ছেলেগুলোকে মারার জন্য আমাদেরই হুমকি দিতে থাকেন।” পুলিশ সূত্রের খবর, শতদ্রু আইপিএস অফিসার বলে ওই ছ’জনের কাছে পরিচয় দেন এবং সেই ব্যাপারে হেয়ার স্ট্রিট থানার পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
কিন্তু ভুয়ো পরিচয় দিয়েই তো শতদ্রু ওই ছ’জনকে কাবু করতে পেরেছিলেন। তা হলে পুলিশ তাঁকে এই ব্যাপারে হেনস্থা করল কেন? লালবাজারের কর্তাদের কাছে এর কোনও সদুত্তর নেই। শতদ্রুর আরও বক্তব্য, “হেয়ার স্ট্রিট থানার অফিসারেরা কিছুতেই আমাদের অভিযোগ দায়ের করতে দিলেন না। পরে জানলাম, ওদের থানায় নিয়ে গিয়ে ঘণ্টা দু’য়েক বসিয়ে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তখন তিন জনে শুক্রবার এসে হেয়ার স্ট্রিট থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।”
শুক্রবার অভিযুক্ত ছয় যুবককে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। কেন এই অভিযোগ বুধবারই নেওয়া হল না? ডিসি (সেন্ট্রাল) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ অবশ্য দাবি করেন, “লালবাজার বা হেয়ার স্ট্রিট থানা লিখিত অভিযোগ নিতে চায়নি, এটা ঠিক নয়। অভিযোগকারীরাই প্রথমে লিখিত অভিযোগ করেননি। তবে এটাও ঠিক, পুলিশও তাঁদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নিতে জোর করেনি।”
ডিসি (সেন্ট্রাল) আরও বলেন, “নিগৃহীতা তরুণীকে পাওয়া যায়নি এবং তিনি কোনও অভিযোগ করেননি, তাই একটা ধোঁয়াশা থেকে গিয়েছিল। সে জন্যই অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।”
পুলিশ-কর্তাদের একাংশ এখনও বলছেন, ঘটনাটি নিছক ইভটিজিং ছাড়া কিছুই নয়। অথচ দিল্লির গণধর্ষণের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই জানিয়েছিল, মহিলাদের সম্মানহানির অভ্যাস অঙ্কুরেই বিনাশ করা প্রয়োজন। ইভটিজিং, মহিলাদের উদ্দেশে অশ্লীল টিকাটিপ্পনি, ইঙ্গিত করে কেউ পার পেয়ে গেলে তারা ভবিষ্যতে আরও বড় অপরাধ করতে পারে এই কারণে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা সংশোধন করে ইভটিজিংয়ের শাস্তি আরও কঠোর করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। |