প্রথম গান ‘হায় রে পোড়া বাঁশি’। পরের গান ‘শুন সাহিবা শুন’। উল্লাস আর হাততালিতে কাঁপছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সরকারি অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ!
তারিয়ে তারিয়ে ‘জলসা’ উপভোগ করছিলেন রাজ্যের আধডজন মন্ত্রীও। একটু বাদেই মঞ্চে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলায় জেলায় পুজো-পার্বণ, যাত্রাপালার আয়োজনে দেদার উপহার ঘোষণা করলেন তিনি। ডিম-পোলাওয়ের ভূরিভোজ সেরে চটুল ফিল্মি গান আর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার রেশটুকু নিয়েই সাহায্যের চেক হাতে স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন আমন্ত্রিত ক্লাবকর্তারা।
শুক্রবার দুপুরে কাছে-দূরের মফস্সল-পাড়াগাঁ থেকে উজিয়ে কলকাতায় আসা কয়েক হাজার ক্লাবের জন্য এটাই সরকারি প্যাকেজ। ইন্ডোরের অনুষ্ঠানে যার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রাখেনি রাজ্য সরকার।
ইংরেজি নববর্ষের সন্ধ্যায় ভাঙড়ে শাসক দলের প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চে মূল আকর্ষণ ছিল খোলামেলা ফিল্মি নাচাগানা! সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সদস্য তথা দলের স্থানীয় নেতা মির তাহের আলিকে পরে সাসপেন্ড করেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তার পরেও এ দিন রাজ্যের ক্রীড়া দফতরের উদ্যোগে মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান মঞ্চেও সেই অকুণ্ঠ বলিউড-টলিউড-প্রীতিই উপচে পড়েছে! |
বিশৃঙ্খলা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সামনে। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র |
আসলে পরিবর্তনের রাজ্যে সংস্কৃতির সংজ্ঞাটাই মমতা বদলে দিয়েছেন বলে কারও কারও অভিমত। রাস্তার মোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত তো মঞ্চে চটুল হিন্দি-বাংলা ফিল্মি গানা! তাঁর আহ্বানে দল ও সরকারের নানান অনুষ্ঠানেই ঘনঘন বলিউড-টলিউডের সরব উপস্থিতি। ব্রিগেডে দলের শহিদ দিবসের মঞ্চে ‘দিদি’র অনুরোধে কোমর দুলিয়ে নেচে উঠেছিলেন বাংলা ছবির এক জনপ্রিয় নায়ক। ইডেনে ‘দিদি’র উপস্থিতিতে ‘ভাই’ শাহরুখের কেকেআর-এর বিজয়-উৎসবও তারকাদের ‘গ্ল্যামার-শো’ হয়ে ওঠে। এফডিআই-বিরোধিতায় মমতার ডাকে বিশিষ্টজনের সমাবেশও ছিল বাজার চলতি ফিল্মি হিট গানে জমজমাট।
ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এ দিনের সরকারি অনুষ্ঠানেও সেই পরম্পরা রক্ষা করা হয়েছে। মঞ্চে অতিথিদের মধ্যে মন্ত্রীরা ছাড়া বলিউডের প্রযোজক বনি কপূরকেও এ দিন দেখা গিয়েছে। গানের মধ্যেই শোনা গিয়েছে ঘোষণা, ‘এখনই আসবেন মুখ্যমন্ত্রী!’ যখন তিনি ঢুকলেন, তখন অবশ্য গায়িকার কণ্ঠে, ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ...।’
দর্শকাসনে উপস্থিত বিভিন্ন জেলার ২৪০০ ক্লাবের সদস্যদের জন্য সহমর্মিতাও ঝরে পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে। “ক্লাবগুলো সব থেকে অবহেলিত, কোনও রকমে স্পনসর জোগাড় করে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, যাত্রা এবং অন্য অনুষ্ঠান করে!”
আর রাজ্য সরকার হয়ে উঠল তাঁদের মুশকিল আসান। সাংসদ ও বিধায়কদের সুপারিশের ভিত্তিতে জেলার ক্লাবগুলিকে খেলাধুলোর উন্নতির জন্য এককালীন দু’লক্ষ করে টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে গত বছর। গত বার রাজ্যের ৭৮১টি ক্লাবকে ওই টাকা দেওয়া হয়। এ বছর তারা এক লক্ষ করে টাকা পাচ্ছে। এ ছাড়া, নতুন ১৬০০টি ক্লাবকে বাছাই করা হচ্ছে। তাদের প্রাপ্তি দু’লক্ষ করে টাকা। সব মিলিয়ে ৪০ কোটি টাকা। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজে কয়েক জনের হাতে চেক তুলে দিয়ে পেরেছেন। ব্যস্ততার জন্য তাঁকে অন্যত্র চলে যেতে হয়। কিন্তু কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি।
কী করবেন এই টাকা নিয়ে?
অনেক ক্লাবকর্তাই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে। যেমন, ইটাহারের তৃণমূল বিধায়ক অমল আচার্যের এলাকার বিচিত্রা সঙ্ঘের কর্তার চওড়া হাসি, “গত বার টাকা পেয়ে দুর্গাপুজোর ফাংশন জমিয়ে দিয়েছিলাম। এ বারেও বড় করে হবে!” পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে কেলেঘাই-কপালেশ্বরী নদীর ধারের ক্লাবকর্তার কর্মসূচিতে মহাপুরুষদের জন্মদিন পালন, বন্যার্তদের সাহায্য, বস্ত্রদান, রক্তদান শিবির ইত্যাদি। আসানসোলের নবনীত ক্লাব বা গঙ্গারামপুরের ‘তরুণের আহ্বান’-ও খেলাধুলোর উন্নয়ন, রক্তদান শিবির, স্বাস্থ্য শিবিরে আগ্রহী।
শালবনির গাছতলা এভারগ্রিন সোসাইটির ভাগ্যে এ বারেই প্রথম সরকারি সাহায্যের শিকে ছিঁড়েছে। তারা বলছে, ওই তল্লাটে অ্যাম্বুল্যান্স নেই। একটা অ্যাম্বুল্যান্স কিনতে হবে! কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নার নির্বাচন কেন্দ্র হরিপালের মোহনবাটি শীতল স্মৃতি সঙ্ঘ দু’লক্ষ টাকায় রাস্তা সংস্কারের কথা বলছে। নানা ভাবে দরিদ্রসেবা, গরিব পড়ুয়াদের বই দেওয়ার কথাও বলছেন কোনও কোনও ক্লাবকর্তা।
ক্লাব-পিছু ডিম-পোলাওয়ের পাঁচটি প্যাকেট। সব মিলিয়ে ১২ হাজার প্যাকেট। চেক হাতে ভূরিভোজের ঢেকুর তুলতে তুলতেই ইন্ডোর থেকে বাড়ির পথে। |